“মহিষাসুরকে বধ করে দুর্গা হয়ে উঠছেন মহিষাসুরমর্দ্দিনী। এটা তো রূপক। মহিষাসুর একজন বাহ্যিক শত্রু। যার আসল মানে তো আমাদের ভিতরের অন্ধকাররূপী অসুরকে বধ করা। বাইরের কোনো শত্রুকে নয়, ভিতরের শত্রুকে তুমি সংহার করো। আমাদের দানবিক, পাশবিক সত্তাটা দমন করাই হচ্ছে মহিষাসুরমর্দ্দিনী-র আসল উদ্দেশ্য। মহিষাসুরমর্দ্দিনী বলতে আমি সেটাই বুঝি।”
বলছিলেন পরিচালক রঞ্জন ঘোষ। তাঁর সাম্প্রতিক ছবি ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী—আ নাইট টু রিমেমবার’ (Mahishasur Marddini- a night to remember) মুক্তি পায় ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে। প্রায় ৫০ দিন চলে ছবিটি। আপাতত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সিনেমাটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের বহু প্রান্তে। পাচ্ছেন অকুণ্ঠ প্রশংসা। কিন্ত বাংলার চলচ্চিত্রমহলে কি উপেক্ষার শিকার ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’? সেই বিষয়েই কথা হয় রঞ্জন ঘোষের (Ranjan Ghosh) সঙ্গে। উঠে আসে সিনেমার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সমাজ ও মানুষের মনস্তত্ত্বের প্রসঙ্গ। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শ্বাশ্বত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
সম্পূর্ণ সিনেমাটির গল্প একটি রাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দুর্গাপূজার পঞ্চমীর রাত। এক বাড়ির গৃহকর্ত্রীর বাড়িতে আসেন কয়েকজন অতিথি। উপস্থিত তাঁর ছাত্রছাত্রীরাও। সেই রাতেই শহরের অপর প্রান্তে গণধর্ষণ করা হয় একটি মূক-বধির মেয়েকে। ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া যায় জঙ্গলে। যার একদিকে শ্মশান, আরেকদিকে কবরস্থান। মর্মান্তিক এই ঘটনার রেশ এসে পড়ে বাড়িটির উপর। উঠতে থাকে অসংখ্য প্রশ্ন—সমাজ নিয়ে, ধর্ম নিয়ে, মানবসভ্যতার ইতিহাস নিয়ে। কোন দিকে এগিয়ে যায় ঘটনার গতিবিধি? কীভাবে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যায় চরিত্ররা? সেই নিয়েই পরিচালক রঞ্জন ঘোষের সিনেমা ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী—আ নাইট টু রিমেমবার’।
২০২২-এ মুক্তি পেলেও এই সিনেমার শিকড় খুঁজতে হবে অতীতে। ২০১২ সালে দিল্লির রাস্তায় গণধর্ষিতা হন নির্ভয়া। খোদ রাজধানীর বুকে এরকম নৃশংস ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায় সারা দেশ। দানা বাঁধে প্রতিবাদ। মোমবাতি মিছিলের ছবিগুলি আজও নীরব সাক্ষ্য দিয়ে যায় সেই ইতিহাসের।
আরও পড়ুন
তেজস্ক্রিয় আবর্জনা ও একটা সিনেমা – দোস্তজী
সেই সময়ের ঘটনার অভিঘাত ভুলতে পারেননি রঞ্জন। শুরু করেন গবেষণা। চলতে থাকে নোট তৈরির প্রক্রিয়া। ধর্ষণ, শুধুই কি ঘৃণ্য অপরাধের বাহ্যিক রূপ? নাকি মানুষের মধ্যে ‘নারীবিদ্বেষ’-এর যে পিশাচটা লুকিয়ে আছে, তারই চরমতম পরিণতি? নির্ভয়াকাণ্ডের পর কেটে গেছে এক দশক। অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। কাশ্মীরের আসিফা, হায়দরাবাদের প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি, হাথরসের দলিত তরুণী কিংবা সাম্প্রতিক মণিপুরের ঘটনা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সমস্যার জট কত গভীরে। যুগ-যুগ ধরে বিদ্বেষের বীজ প্রোথিত হয়ে আছে নারী-পুরুষ সকলের মধ্যেই। ঘরে-বাইরে নিত্যদিন দেখা যায় তার চরমতম রূপ।
আরও পড়ুন
বাংলা সিনেমার ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো ফ্লপ ‘পাতালঘর’ : অর্জুন গৌরিসারিয়া
তাই প্রশ্ন তুলেছেন রঞ্জন। আসল শত্রু কে? বা কারা? নাকি পাপ সকলের মধ্যেই? আর সেই জন্যই কাউকে ‘ভিলেইন’ তৈরি করে বাঁচানো হয় নিজেদের উপরতলার সামাজিক সত্তাটাকে। ভিতরের ধর্ষকাম চরিত্রটা হাসতে থাকে অলক্ষ্যে।
শুধু সিনেমার বক্তব্যের দিক থেকে নয়, রঞ্জন পরীক্ষা চালিয়েছেন ফর্ম নিয়েও। সে অর্থে কোনো গল্প এই সিনেমায় নেই। যেন সাতটি অঙ্কে ভাগ করা নাটক। একটা উঠোনের গল্প, একটা রাতের গল্প। দৃশ্যপট, আলোও সেভাবেই সজ্জিত। অ্যারিস্টটলের ‘পোয়েটিক্স’-এর অন্তর্গত স্থান-কাল-ঘটনাপ্রবাহ– এই তিনটি ঐক্যের সূত্র মিলে যায় ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’-তে। মিলে যায় থিয়েটার ও সিনেমা।
গত বছর দিল্লির ‘হ্যাবিটাট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এর জন্য সিনেমাটি পাঠান তিনি। সিনেমার আঙ্গিকটিকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় মনে করেন ফেস্টিভ্যালের সদস্যরা। সেপ্টেম্বরে তাঁদের নাট্যোৎসবে দেখানো হয় ছবিটি। ঘটনাচক্রে সেখানে উপস্থিত ছিলেন দিল্লির জেএনইউ-এর ফিল্ম স্টাডিজ-এর অধ্যাপক ডঃ ইরা ভাস্কর। সিনেমাটির যে একটি অ্যাকাডেমিক মূল্য রয়েছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
সেখান থেকে শুরু। তারপর পণ্ডিচেরি, হায়দরাবাদ, কেরালা, পুণে, মুম্বইয়ের বিভিন্ন প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে প্রদর্শিত হয় সিনেমাটি। সম্প্রতি দেখিয়েছেন এফটিআইআই পুণে এবং আইআইটি বোম্বে-তে। তাঁদের থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। রঞ্জন বলেন,
“আমার কাছে ওটাই সবচেয়ে বড়ো বিস্ময়। তেলুগু, তামিল, মালয়ালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধী, মারাঠি, এমনকি হিন্দিভাষীরাও ছবিটা দেখে দু-হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন। আগ্রহ দেখিয়েছেন। সিনেমাটা কথোপকথন-নির্ভর, সাবটাইটেল পড়তে হবে। তবুও তাঁরা ধৈর্য ধরে বসে, দেখে, বুঝে ছবিটাকে যাচাই করে পুরো মতামত দিলেন। সেটাই আমার সবচেয়ে বড়ো পাথেয়।”
আর বাংলায়? খানিক দুঃখ ঝড়ে পড়ে তাঁর গলায়। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রশংসিত হলেও এখানকার কোনো জায়গা থেকে ডাক পাননি। নাম ওঠেনি কোনো চলচ্চিত্র পুরস্কারের ‘নমিনেশন’ তালিকায়। ফলে মেলেনি পুরস্কারও। আপাতত চেষ্টা করছেন কোনো ‘ওয়েব প্লাটফর্ম’-এ সিনেমাটি মুক্তির বিষয়ে। সম্প্রতি কল্যাণীর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’-এর ডাক পেয়েছেন। শীঘ্রই প্রদর্শিত হবে সেখানে। অবশেষে ঘরের মাটিতে ফেরার সুযোগ পেয়েছে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। যদিও জানেন না, পরবর্তী গন্তব্য কোথায়?
তবু তিনি ভরসা রাখেন নিজের দর্শকের উপরে। বিদেশে পাঠিয়ে সিনেমার মুকুটে পালক লাগানোর পক্ষপাতী তিনি নন। পূর্ণ আস্থা আছে নিজের সিনেমার প্রতি। ভরসা রাখেন পরীক্ষায়। সেই বিশ্বাসেই এগিয়ে যেতে চান রঞ্জন।
Powered by Froala Editor