প্রিয় ক্রিকেটারকে খেলতে দেখতে ভক্তরা অনেক কিছুই করতে পারেন। কাজে বা পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া বা বাড়িতে টিভির রিমোট নিয়ে মারামারি, এসব তো অতি তুচ্ছ। কিন্তু যদি বলা হয়, একটি ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য রাত কাটাতে হবে জেলখানায়? এমন অসম্ভব শর্তেই রাজি হয়ে গিয়েছেন খোদ গান্ধীজির কনিষ্ঠ পুত্র দেবদাস। পরাধীন ভারতে নয়, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারতের নাগরিক দেবদাস ১৯৪৮ সালে রাত কাটিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের জেলখানায়। কারণটা আর কিছুই না, প্রিয় ব্যাটসম্যানের শেষ আন্তর্জাতিক সিরিজের সাক্ষী থাকতে চান তিনি। আর সেই ক্রিকেটারের পরিচয়? তিনিও ক্রিকেটের ইতিহাসের এক প্রবাদপুরুষ। ডন ব্র্যাডম্যান।
কথায় বলে শত্রুর শত্রু আমাদের মিত্র। এই প্রবাদবাক্যে ভরসা রেখেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির সঙ্গে চুক্তিস্থাপন করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র। গান্ধীজি নিজে অবশ্য ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য কোনো বৈদেশিক শক্তির সাহায্য গ্রহণ করেননি। বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদী জার্মানিকে পরাস্ত করতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার কথাও ভেবেছিলেন তিনি। শুধু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে শিক্ষা নিয়েই সেই আলোচনা আর বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যাননি। তবে যে দেশ ভারতবর্ষকে ২০০ বছর ধরে পরাধীন করে রেখেছিল, খেলার মাঠে হোক বা অন্যত্র, সেই দেশের অসহায় পরাজয় দেখলে ভারতবাসীর রক্ত গরম হয়ে উঠবেই। সেই অনুভূতিটিরই সাক্ষী থাকতে চেয়েছিলেন দেবদাস গান্ধী।
১৯৪৮ সালের জুন মাস। সেই বছরের গোড়াতেই নাথুরাম গডসের গুলিতে নিহত হয়েছেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর চার ছেলের কেউই জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেননি। দেবদাস গান্ধী তখন হিন্দুস্তান টাইমসের এডিটর জেনারেল। রয়টার্স পত্রিকার সঙ্গে একটি আলোচনার জন্য তাঁকে লন্ডন যেতে হবে। সহকর্মীরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আলোচনার পর তিনি কী করবেন? হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, ডন ব্র্যাডম্যানের জীবনের শেষ আন্তর্জাতিক সিরিজের সাক্ষী থাকবেন তিনি। খেলাধুলোর প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বরাবরই। মূলত তিনিই হিন্দুস্তান টাইমসের খেলাধুলোর পাতাটি ঢেলে সাজিয়েছিলেন। আর ব্র্যাডম্যান তো তাঁর কাছে ঈশ্বর। সেই ঈশ্বরের কাছে ব্রিটিশ বাহিনীর পরাজয়ের সাক্ষী না হয়ে কি থাকা যায়?
যথা সময়ে রয়টার্স পত্রিকার সঙ্গে আলোচনা শেষ হল। দেবদাস রওয়ানা হলেন নটিংহামের ট্রেন্ট ব্রিজের উদ্দেশে। ১০ জুন ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া সিরিজের প্রথম টেস্ট শুরু হবে। ৯ জুন রাতে নটিংহাম পৌঁছে অবাক দেবদাস। শহরের কোনো হোটেল বা লজে একরাত থাকার জায়গা নেই। হবে নাই বা কেন? ব্র্যাডম্যানের শেষ সিরিজ দেখতে নানা দেশ থেকে ছুটে এসেছেন মানুষ। কিন্তু এই ঐতিহাসিক ম্যাচ না দেখে ফিরতে রাজি নন দেবদাস। কী করা যায়? শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন জেলে। হ্যাঁ, নটিংহাম কাউন্টি জেলে। সেখানে কারারক্ষীদের কীভাবে রাজি করিয়েছিলেন, তা এক বিস্ময়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একরাতের জন্য আসামীদের সঙ্গে থাকার অনুমতি আদায় করে নিলেন। সকালে আসামীদের সঙ্গেই খাওয়াদাওয়ার পর রওয়ানা হলেন খেলার মাঠের উদ্দেশে।
আরও পড়ুন
অর্থ তছরুপ ও জালিয়াতিতে দোষী মহাত্মা গান্ধীর প্রপৌত্রী!
প্রথম দিন অবশ্য মাঠে নামলেন না ব্র্যাডম্যান। ১৬৫ রানে প্রথম দিনেই সমস্ত উইকেট হারায় ইংল্যান্ড বাহিনী। তাই আবারও একরাত জেলখানায় কাটালেন দেবদাস। পরদিন অস্ট্রেলিয়ার সঞ্চয় যখন ৭৩ রান, তখন মাঠে নামলেন ব্র্যাডম্যান। তাঁর প্রথমদিকের খেলা দেখে হতাশ হয়েছিলেন অনেকেই। প্রায় ২ ঘণ্টা একটিও বাউন্ডারি মারতে দেখা যায়নি তাঁকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় ইনিংসের শেষে ১৩০ রানে অপরাজিত ব্র্যাডম্যান। এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত দুচোখে মেখে সোজা লন্ডন ফিরেছিলেন দেবদাস। সেখান থেকে মুম্বাই। আর সেই সিরিজের চারটি টেস্টেই ইংল্যান্ড বাহিনীকে দুরমুশ করেছিল অস্ট্রেলিয়া।
আরও পড়ুন
শেষ ১৪ বছরে পাঁচবার হত্যার চেষ্টা, ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী
জেলখানায় রাত কাটানো অবশ্য গান্ধীজির কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয় ছিল। তিনি জেলখানাকে বলতেন মহারানির হোটেল। আর দেবদাস গান্ধীও লবন সত্যাগ্রহের সময় দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। কিন্তু সেসব তো রাজনৈতিক কারণে। নিছক একটি ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য জেলখানায় রাত কাটানো? এমন ঘটনা অবাক করে বৈকি!
আরও পড়ুন
ঠাকুরবাড়ির সরলাকে ‘আধ্যাত্মিক স্ত্রী’ হিসেবে চেয়েছিলেন গান্ধীজি, পিছিয়ে আসেন কস্তুরবার চাপে
Powered by Froala Editor