মহাত্মা গান্ধী ও ‘জাতির জনক’ আখ্যা— একটি বিতর্ক

ভারতের জাতির জনক কে? এমন প্রশ্ন করা হলে, সকলের মুখেই এক বাক্যে শোনা যাবে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর (Gandhiji) নাম। কৈশোর থেকে এমনটাই যে শিখেছি আমরা সকলে। কিন্তু যদি বলা হয়, আদতে সরকারিভাবে ভারতের ‘জাতির জনক’ (Father Of The Nation) নন তিনি।

আশ্চর্য শুনতে লাগলেও কথাটি সত্যি! কিন্তু কারণটা কী? স্বাভাবিকভাবেই যে চিন্তাটা মনের মধ্যে উঁকি দেওয়ার কথা, তা হল, বর্তমান রাজনীতির হাওয়াতেই হয়তো গান্ধীজির নামের আগে থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে ‘জাতির জনক’ কথাটি। তবে ব্যাপারটা এমন নয় মোটেই। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে কোনোদিনই স্বাধীন ভারতের ‘জাতির জনক’ ছিলেন না তিনি।

খুলে বলা যাক বিষয়টা। ১৯৪৪ সাল। ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য মায়ানমার আক্রমণ করে সুভাষচন্দ্রের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। তার ঠিক আগে সিঙ্গাপুর থেকে গোটা দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে আজাদ হিন্দ রেডিও-তে বিশেষ বক্তৃতা প্রদান করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সেই বক্তৃতাতেই প্রথম গান্ধীজিকে ‘ফাদার অফ দ্য নেশন’, অর্থাৎ ‘জাতির জনক’ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। আইএনএ-এর ‘দিল্লি চলো’ অভিযান শেষ পর্যন্ত সফল না-হলেও, ভারতের সাধারণ মানুষের মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিল সুভাষচন্দ্রের বক্তৃতা, আইএনএ-এর সংগ্রাম। এমনকি আজাদ হিন্দ রেডিও-র সেই সম্প্রচারের পরই দেশের মানুষের কাছে ‘জাতির জনক’ হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন গান্ধীজি। 

অবশ্য ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে গান্ধীজিকে ‘জাতির জনক’ হিসাবে কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি ভারত সরকার। না, তার পিছনে কোনো রাজনৈতিক রোষ কিংবা চক্রান্ত দায়ী নয়। বরং, এই ঘটনার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে ভারতের আইন। 

২১ মে, ২০১২ সাল। স্বাধীনতার ৬৫ বছর পরেও, মহাত্মা গান্ধীকে কেন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতির জনক’-এর স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, তা জানতে চেয়েই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে আরটিআই দায়ের করেছিলেন সমাজকর্মী অভিষেক কাদিয়ান। এই আরটিআই-এর প্রেক্ষিতেই সেন্ট্রাল পাবলিক ইনফর্মেশন ডিরেক্টরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রশাসনিকভাবে এই উপাধি কোনোদিনই দেওয়া হয়নি গান্ধীজিকে। আর গান্ধীজিকে এই উপাধি প্রদান করতে গেলে বদলাতে হবে ভারতীয় সংবিধানের একটি বিশেষ অনুচ্ছেদ। 

অনুচ্ছেদ ১৮(১)। ভারতীয় সংবিধানের এই বিশেষ আইনে উল্লেখিত রয়েছে শিক্ষা মাধ্যম এবং সামরিক ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রেই কোনো ব্যক্তির নামের আগে উপাধি অনুমোদন করে না ভারতের প্রজাতন্ত্র। ‘অ্যাবোলিশন অফ টাইটেল’-খ্যাত এই অনুচ্ছেদের আওতাতেই স্বাধীন ভারতে সংবিধান লাগু হওয়ার পরে, অবলুপ্ত হয়েছিল ‘জমিদার’, ‘তর্কালঙ্কার’ ইত্যাদি উপাধি। গান্ধীজির নামের আগে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতির জনক’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হলে, তা উপাধি হিসাবেই স্বীকৃত হবে। আর তেমনটা হলে, লঙ্ঘিত হবে ভারতের সংবিধান। 

২০১৩ সালে এই একই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে আদলতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন লখনৌয়ের ষষ্ঠী শ্রেণির ছাত্রী ঐশ্বর্য পরাশর। সে-সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এসএ বোবদে, বিআর গাভাই এবং সূর্য কান্তকে নিয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছিল, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বাইরে গিয়েও জনমতে গান্ধীজি সকল ভারতীয়ের কাছেই জাতির পিতা। প্রত্যেক ভারতীয়ের সম্মান করা উচিত তাঁকে। তার জন্য পৃথকভাবে আইন প্রণয়নের প্রয়োজন নেই। 

শুধু গান্ধীজির ক্ষেত্রেই নয়, সুভাষচন্দ্রের নামের আগে ব্যবহৃত ‘নেতাজি’, চিত্তরঞ্জন দাশের নামের আগে ব্যবহৃত ‘দেশবন্ধু’-ও পড়ে এই তালিকাতেই। এই শব্দবন্ধগুলিকেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনোদিনই স্বীকৃতি দেয়নি ভারত সরকার। কেবলমাত্র লোকমুখেই তা প্রচারিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, কিংবদন্তি এইসকল ব্যক্তিত্বদের প্রতিটি উপাধির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে কোনো-না-কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি হিসাবে কম দুর্নাম নেই ভারতবাসীর। অথচ সরকারি স্বীকৃতি ছাড়াই দেশের মানুষের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বদের নামের আগে ব্যবহার করে চলেছে তাঁদের ঐতিহাসিক উপাধি, সম্মান জ্ঞাপন করে চলেছে অন্তর থেকে— তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় বইকি!

Powered by Froala Editor