ছোটোবেলা কেটেছে চরমতম দারিদ্র্যে। নুন আনতে পান্তা ফুরোত ভাঁড়ার ঘরে। তাই একটু বয়স বাড়তেই কাঁধে এসে জুটেছিল উপার্জনের দায়ভার। তবে এসব প্রতিকূলতা দমাতে পারেনি তাঁকে। শত কষ্টের মধ্যেও চালিয়ে গিয়েছিলেন পড়াশোনা। এ যেন এক স্বপ্নের উড়ান। তবে এখানেই গল্পের শেষ নয়। পরবর্তীতে গ্রামের ভোল বদল করতে শিক্ষকতার পেশাকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। আর সেখানে যে একশো শতাংশ সফল, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। রঞ্জিত সিং দিসালে। মহারাষ্ট্রের প্রান্তিক গ্রামের এই শিক্ষকই এবার নির্বাচিত হলেন বিশ্ব ব্যাঙ্কের শিক্ষা পরামর্শদাতা হিসাবে।
মহারাষ্ট্রের সোলাপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম দিসালের। ছোটো থেকেই খানিক ‘ব্যতিক্রমী’ ছিলেন রঞ্জিত। পড়াশোনাই ছিল জীবনে মূলমন্ত্র। স্বপ্ন ছিল বড়ো হয়ে সফল তথ্য প্রযুক্তি ইঞ্জিনিয়ার হবেন তিনি। সেই মতো ভর্তিও হয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। কিন্তু শেষ হয়ে উঠল না পড়াশোনা। কোথাও যেন বিষয়টার সঙ্গেই মানিয়ে নিতে পারছিলেন না তিনি। ফলত, পথপরিবর্তন। ঘিরে ধরছিল হতাশা, অবসাদও। শেষ পর্যন্ত বাবার কথাতেই নতুন করে শুরু করলেন শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ। প্রথমদিকে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাই যেন সারাদিন তাড়া করে বেড়াত তাঁকে। তবে ধীরে ধীরে তিনি ভালোবেসে ফেললেন এই পেশাটাকে। নতুন করে খুঁজে পেলেন হারানো শৈশব।
২০০৯ সাল। গ্রাম পরিষদেরই একটি অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন রঞ্জিত। তবে নামেই স্কুল। তার সর্বাঙ্গে লেগে অবহেলার ছাপ। প্রথমত অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। তার ওপরে অভিভাবকরাও সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে ছিলেন যথেষ্ট উদাসীন। রঞ্জিত দেখলেন, শিশুকন্যাদের বিবাহ দিয়ে ঘাড় থেকে ‘বোঝা’ নামানোর মানসিকতাই যেন ঘিরে রেখেছে তাঁদের। এই মানসিকতার বদল না হলে, কখনোই পাল্টাবে না গ্রামের পরিস্থিতি।
সেই কাঙ্খিত বদল আনতেই পড়ানোর পাশাপাশি আরেক নতুন লড়াই শুরু করলেন রঞ্জিত। শুরু হল অভিভাবকদের কাউন্সিলিং। কোনো সহকর্মী নেই, নেই আলাদা কোনো পরিকাঠামোও। একক উদ্যোগে নিজেই বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বোঝানো শুরু করলেন অভিভাবকদের। সেইসঙ্গে ইংরাজি থেকে ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার জন্য মাতৃভাষাতেও পাঠ্যবই অনুবাদ করেন তিনি। এমনকি তাতে সংযোজন করেছেন কিউ.আর. কোডও। যা লকডাউনের সময়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে ছাত্রছাত্রীদের।
আরও পড়ুন
কলকাতার বুকে গেরিলা গার্ডেনিং বাংলার শিক্ষকের
বিগত ১১ বছরের এই লড়াই যে কতটা সফল, তা বোঝা যাবে মহারাষ্ট্রের এই প্রত্যন্ত গ্রামে গেলেই। শেষ কয়েক বছর ধরেই স্কুলে ছাত্রীদের উপস্থিতির হার ১০০ শতাংশ। পাশপাশি ঘটেনি একটিও নাবালিকা বিবাহের ঘটনা। এই অনস্বীকার্য কৃতিত্বের জন্যই গতবছর ডিসেম্বর মাসে বিশ্ব শিক্ষক পুরস্কার পান রঞ্জিত সিং। যা শিক্ষকতার জগতে নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য হিসাবেই বিবেচিত হয়। তবে সেখানেও এক অনন্য নজির তৈরি করেছিলেন তিনি। ১০ লক্ষ ডলারের পুরস্কার মূল্য একা নিতে অস্বীকার করেন তিনি। ‘বিশ্ব শিক্ষক’ হিসাবে মনোনীত ১০ জন শিক্ষকের মধ্যে তিনি তা ভাগ করে দিয়েছিলেন সমানভাবে। আর নিজের যেটুকু প্রাপ্য সেটাও পরবর্তীতে কাজে লাগান গ্রামের শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নে। এমন এক ব্যক্তিত্বই এবার বিশ্ব ব্যাঙ্কের শিক্ষা প্রকল্পের পরামর্শদাতার দায়িত্ব তুলে নিলেন কাঁধে। ফলত, যে গোটা বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসতে চলেছে শীঘ্রই, সে ব্যাপারে আশাবাদী আন্তর্জাতিক শিক্ষাবিদরা। আর দেশের কাছে এমন সম্মাননা, গর্বের বিষয় তো বটেই…
আরও পড়ুন
ভোট নিতে গিয়ে কোভিডে মৃত ১৬২১ শিক্ষক, অভিযোগ যোগী প্রশাসনের দিকে
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
পরিবেশ বাঁচাতে ইন্দোনেশিয়ার শিক্ষকের হাতিয়ার শিশুরাই