কলকাতা, এলাহাবাদ, মুম্বাই বা চেন্নাই— ভারতের প্রায় সমস্ত শহরেই রয়েছে জাতীয় মিউজিয়াম। প্রতিদিনই সেখানে ভিড় জমান হাজার হাজার মানুষ। দল বেঁধে কখনও কখনও হাজির হয় খুদে পড়ুয়ারাও। কিন্তু শহর থেকে একটু দূরে প্রান্তিক অঞ্চলে যে-সব কিশোর-কিশোরীর বাড়ি? তারা কি আদৌ স্বাদ পায় এইসব ঐতিহাসিক নিদর্শন সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করার? এমনকি প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে ন্যূনতম ধারণা বা আকর্ষণ গড়ে না-ওঠার জন্য আঞ্চলিক ইতিহাস সংরক্ষণেও হয়তো ততটা আগ্রহ তৈরি হয় না তাদের মধ্যে।
প্রায় এক দশক আগের কথা। প্রান্তিক মহারাষ্ট্রে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়েই এই বিষয়টা নজর কেড়েছিল ঐতিহাসিক কৃত্তিকা মাত্রের। ঠিক যেমন শিক্ষার পরিকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে শহরের থেকে প্রান্তিক ছাত্ররা খানিকটা পিছিয়ে থাকে, তেমনই ইতিহাসের ব্যাপারে তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে বিস্তর। কিন্তু কীভাবে তাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করা যায় ইতিহাস সম্পর্কে? কীভাবে তাদের ফেরানো যায় মূলস্রোতে? এক অভিনব সমাধান খুঁজে বার করেছিলেন কৃত্তিকা। পরিকল্পনা করেছিলেন, খোদ ‘মিউজিয়াম’ নিয়ে তিনি হাজির হবেন প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের কাছে।
২০১৫ সাল। মুম্বাইয়ের ‘ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ বাস্তু সংগ্রহালয়’-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন কৃত্তিকা। চালু করেন ‘মিউজিয়াম অন হুইলস’ (Museum On Wheels) প্রকল্প। প্রাথমিকভাবে একটি যাত্রীবাহী বাসকে সম্পূর্ণভাবে বদলে ফেলা হয়েছিল ভ্রাম্যমাণ মিউজিয়ামে। ঐতিহাসিক হওয়ার দরুন খুব সহজেই মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের থেকে প্রত্নসামগ্রী প্রদর্শনের অনুমতিও পেয়ে যান তিনি। তারপর শুরু হয় অভিযান। ইতিহাসের নিদর্শন, প্রত্নবস্তু, শিল্প-সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের চিহ্ন নিয়ে হাজির হন প্রান্তিক ভারতের কচিকাঁচাদের কাছে।
২০১৫ থেকে শুরু করে ২০২৩— বিগত ৮ বছরে দেশজুড়ে ৭০০টিরও বেশি শহর, গ্রাম ও মফঃস্বলে ভ্রমণ করেছেন কৃত্তিকা। লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক মানুষ ও ছাত্রছাত্রীদের স্বাদ দিয়েছেন প্রত্ন-পর্যবেক্ষণের। আগ্রহী করে তুলেছেন ইতিহাসচর্চায়। এমনকি বিগত কয়েক বছরে বেড়েছে এই ভ্রাম্যমাণ মিউজিয়ামের আয়তনও। প্রথমে একটি মাত্র বাসে বিভিন্ন প্রত্নসামগ্রী বোঝাই করে কৃত্তিকা পৌঁছে যেতেন প্রান্তিক অঞ্চলে। বর্তমানে বাসের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩টিতে।
তবে আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ভ্রাম্যমাণ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত প্রত্নসামগ্রী ও মিউজিয়ামের থিমও বদলে যায় ৬ মাস অন্তর অন্তর। অবশ্য সেটা পরিকল্পনাহীনভাবে নয়। মুম্বাইয়ের স্থানীয় এবং প্রান্তিক মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্কুলের ইতিহাস শিক্ষক এবং মহারাষ্ট্রের মিউজিয়ামের কিউরেটরদের নিয়ে ৬ মাস ছাড়া ছাড়া বিশেষ বৈঠকের আয়োজন করেন কৃত্তিকা। বোঝার চেষ্টা করেন, তরুণ প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে ইতিহাসের কোন কোন অধ্যায়গুলি। তারপর সামর্থ্য মতো সেই সম্পর্কিত প্রত্নবস্তু নিয়েই শুরু হয় অভিযান।
বিগত সাত বছরের অভিজ্ঞতার সূত্রেই কৃত্তিকার অভিমত, এই উদ্যোগ শিশুদের, বিশেষত গ্রামীণ শিশুদের মধ্যে ইতিহাস সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলেছে অনেকটাই। এমনকি বর্তমানে শহরের মিউজিয়ামে প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এইধরনের পরিষেবা ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও চালু হলে বদলে যেতে পারে শিক্ষার পরিমণ্ডল, জানাচ্ছেন তিনি।
Powered by Froala Editor