১৯৫৯ সাল। আরও একটা দশক শেষ হতে চলল। ভবিষ্যতের দিনগুলো কেমন হতে চলেছে, কেউ জানে না। তখন ছিল গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগ। আর কলকাতা তো সিনে ও সঙ্গীতমহলের স্বর্গরাজ্য। কাজেই সবার নজর তিলোত্তমার দিকে। পুজো আসতে তখনও বেশ দেরি। জুলাইয়ের শেষ লগ্নে হঠাৎই একটি খবরে তাক লেগে গেল বঙ্গবাসীর। কলকাতারই একটি রেকর্ড কোম্পানি থেকে বের হচ্ছে এক ‘নবাগতা’র গানের প্রথম রেকর্ড। এরকম তো প্রায় প্রতিবছরই হয়। আজ এত আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? এমন সময় চোখ গেল ‘নবাগতা’র নামের দিকে। এক মুহূর্ত চমকে উঠলেন সবাই। ঠিক দেখছেন কি? যিনি গান গেয়েছেন, তাঁর নাম যে সুচিত্রা সেন!
বাঙালি কি কখনও ভুলতে পারবে এই নামটি! তিনি যে আমাদের মহানায়িকা! পর্দায় যাঁর অভিনয়, রূপ মুগ্ধ করে রেখেছে কয়েক প্রজন্মকে। বাইক ছুটে চলেছে রাস্তা দিয়ে। চালকের আসনে উত্তমকুমার, সঙ্গে তাঁর ভুবনভোলানো হাসি। আর তাঁর পেছনে? সেই স্বপ্নের নারী, সুচিত্রা সেন। বাংলার গার্বো। ‘সপ্তপদী’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘হারানো সুর’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’— নাম যে শেষ হবার নয়। আর শুধুই কি সিনেমা? সুচিত্রার লিপে অমরত্ব পেয়েছে একের পর এক গান। কী করে করতেন অমন নিখুঁত লিপ? মাঝে মাঝে অবাকই হয়ে যেতেন গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এত বিখ্যাত গানের জন্ম দিয়েছেন দুজনে; কিন্তু ওই লিপ দেওয়ার ক্ষমতা অবাক করে দিত সকলকে…
গান ও সুরের ধারণা, গানের আত্মার ভেতর প্রবেশ না করলে কি অমন কাজ করা যায়? ভেতরে ভেতরে সরগমের ওপর দখল কি ছিল ‘মিসেস সেনের’? গবেষকরা অন্তত তাই বলছেন। অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের কাছে কোথাও চাপা পড়ে গিয়েছিলেন ‘গায়িকা’ সুচিত্রা সেন। এই প্রসঙ্গে গবেষক দেবদত্ত গুপ্ত বলছিলেন, ‘সঙ্গীতচর্চা ওঁর মধ্যে অবশ্যই ছিল। মনে রাখতে হবে, তখনকার দিনে বাংলার ঘরে ঘরে গান-নাচ শেখার একটা চর্চা ছিল। বিশেষ করে বাড়ির মেয়েদেরকে একটু গান বা নাচের তালিম দেওয়া হত। সেই ব্যাপারটি সুচিত্রা সেনের ক্ষেত্রেও যে ঘটবে, তাতে আশ্চর্য নেই। পরবর্তীকালে দেখেছি, তাঁর সঙ্গে শান্তিনিকেতনেরও যোগ ছিল। সুচিত্রা সেনের বোন স্বয়ং কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীত ভবনে গান শিখেছেন। কাজেই, একটা রেওয়াজ তো ছিলই পরিবারে। অভিনেত্রী হওয়ার পর রেকর্ডিংয়ের যোগাযোগটা তাঁর কাছে আসে।’
পঞ্চাশের দশক। উত্তম-সুচিত্রা দুজনেরই আত্মপ্রকাশ ঘটে গেছে এই সময়। একের পর এক হিট ছবি, আর স্বপ্নের জুটির বেড়ে ওঠা। এমন সময়ই এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কমল ঘোষ। ইনি ছিলেন মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির কর্ণধার। তিনি ঠিক করলেন, বেশ কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দিয়ে তিনি গান গাওয়াবেন। তারপর সেই রেকর্ড নিয়ে আসবেন বাংলার দর্শক-শ্রোতার সামনে। আর এই কাজেই তিনি বাছলেন সুচিত্রা সেনকে। প্রথমে হয়ত কমলবাবু ভেবেছিলেন, রাজি হবেন তো ‘মিসেস সেন’? সমস্ত সংশয় দূর করে, সেই আহ্বানে সাড়া দিলেন সুচিত্রা নিজে। ইতিহাস তৈরি হওয়া তখন সময়ের অপেক্ষা।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার হাজির হলেন গানের কথা নিয়ে। ‘আমার নতুন গানের নিমন্ত্রণে’, আর ‘বনে নয় আজ মনে হয়’। কথায় সুর জুড়লেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। আর কণ্ঠে সুচিত্রা সেন! তৈরি হল রেকর্ড। এই প্রথম সুচিত্রা সেন মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন একেবারে অন্য রূপে। নায়িকা হিসেবে তো সবাই সাদরে গ্রহণ করেছে তাঁকে; গানেও কি করবে? ঠিক যেন নবাগতা এক গায়িকা দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছেন তাঁর শ্রোতাদের জন্য। অবশ্য তাঁরাও হতাশ করেননি মহানায়িকাকে। ১৯৫৯ সালের জুলাই মাসে রেকর্ড বেরনোর পর বেশ ভালোই বিক্রি হয়েছিল। এবং সবাই অবাক হয়ে শুনলেন বাংলার গার্বোর গান।
আরও পড়ুন
স্কুলের যাত্রাভিনয়ে প্রথম পুরস্কার প্রাপ্তি; মঞ্চই তৈরি করেছিল ‘অভিনেতা’ উত্তমকে
সেটাই ছিল প্রথম, সেটাই শেষ। বাংলা তথা ভারতের চলচ্চিত্রের ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে এক কিংবদন্তি অভিনেত্রী হিসেবে। যিনি থামতে জানতেন। যিনি জানতেন প্রতিভাকে কীভাবে আর কতদূর অবধি ধরে রাখতে হয়। ওই ব্যক্তিত্ব, তেজ, রূপ আর প্রতিজ্ঞার সামনে কে আর দাঁড়াতে পারত। তবে আক্ষেপ, গায়িকা সুচিত্রা সেনের পরিচয় সেভাবে সামনে উঠে এল না। এই দুটি গানই কেবল সম্বল। যেন জানিয়ে গেলেন নিজের অস্তিত্ব। সুচিত্রা সেন এমনই…
তথ্যসূত্র-
১) দেবদত্ত গুপ্ত
২) ‘অপার রহস্যের মিথ মহানায়িকা সুচিত্রা’, পীর হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ প্রতিদিন
৩) ‘গান রেকর্ড করলেন সুচিত্রা সেন’, দেবদত্ত গুপ্ত, বঙ্গদর্শন
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
'ও আমাকে টাচ্ করবে না' - বললেন সুচিত্রা, কথা না শুনেই বাজিমাত উত্তমের