মৃত্যুশয্যাতেও ফেরাননি পিসি সরকারকে, হাসপাতালে শুয়েই জাদু দেখালেন সুশীলকুমার

তখন কালীঘাট বা রাসবিহারীর মোড় এত ঘিঞ্জি ছিল না। রাস্তার মোড়ে এক জাদুকর একদিন খেলা দেখাতে দেখাতে বাঁশি বাজিয়ে লোক জড়ো করছেন। হাতের মধ্যে একটা দেশলাই বাক্স রয়েছে তাঁর। আপনা থেকেই খুলে যাচ্ছে সেই বাক্সটা। তারপর একটা খালি বাক্স দেখিয়ে উলটে রেখে দিলেন তিনি। তারপর তা সোজা করতেই সেখান থেকে বেরিয়ে এল দুটো গিনিপিগ। এমনই ছোটোখাটো খেলা দেখতে ভিড়ও জমেছে বেশ। লোকজনও আনন্দ পাচ্ছেন।

তবে ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা বাচ্চা ছেলে সমানে দুষ্টুমি করে যাচ্ছে তাঁর সামনে। সে বারবার বলতে লাগল আমিও জানি খেলাটা। বেশ কয়েকবার জাদুকর বারণ করার পর কথা না শোনায় তিনি ধুলো ছুঁড়ে মারলেন ছেলেটিকে। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটির সারা গা চুলকাতে লাগল। কিছুক্ষণ ছেলেটা ছটফট করার পরে দর্শকদের অনুরোধে খানিকটা ধুলো ছুঁড়ে, তাকে আবার শান্ত করলেন জাদুকর। ছেলেটা বেশ কিছুক্ষণ শান্ত থাকার পরে আবার শুরু করল বাঁদরামো। জাদুকর আবার খানিকটা ধুলো ছুঁড়ে মারলেন। এবার সে কাটা ছাগলের মতোই ছট-ফট করতে লাগল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত। দর্শকরা অনেকে অনেক অনুরোধ করলেও জাদুকর এবার আর ক্ষমা করার পাত্র নয়। এমন সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বেরিয়ে এলেন। অনুরোধ করলেন ‘তুমি ওর থেকে এই বাণ তুলে নাও।’

জাদুকর শান্ত না হয়েই সেই ব্যক্তিকে রীতিমতো ভয় দেখালেন, ‘আমাকে অনুরোধ করবেন না। নইলে আপনাকেও মজা দেখিয়ে দেব।’ জাদুকরের স্পর্ধা দেখে খানিকটা অবাক হলেন তিনি। মাটি থেকে খানিকটা ধুলো নিয়ে নিজের মাথার চারিদিকে ঘুরিয়ে মন্ত্র পড়লেন। তারপর ছুঁড়ে দিলেন বাচ্চা ছেলেটার দিকে। তৎক্ষণাৎ ছটফটানি থেমে গেল তার। জাদুকর রেগে উঠলেন আরও। তাঁর রোষের মুখে পড়েও শান্তভাবেই তাঁর দিকে খানিকটা ধুলো ছুঁড়ে দিলেন ওই ব্যক্তি। সঙ্গে সঙ্গে জাদুকরের হাতের বাঁশিটা তাঁর গলার ভিতরে ঢুকে যেতে থাকল। দর্শকরা প্রথমে মজা পেলেও কেউ কেউও অনুরোধ করলেন এ যাত্রায় জাদুকরকে ছেড়ে দিতে। তিনি সেই ‘বাণ’ সরিয়ে নিলেন। চলে যাওয়ার আগে তাঁকে বলে গেলেন, ‘খেলার ছলে কোনোদিন কারোর ওপর জাদুশক্তির অপব্যবহার কোরো না। এতে মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে।’

গুরু-শিষ্য : সুশীলবাবুর সঙ্গে আমার একটি ছবি

 

 এই ঘটনা লোকমুখে শোনা গল্প নয়। এই ঘটনা আমি চাক্ষুষ উপলব্ধি করেছিলাম একেবারে সামনে থেকেই। আর জাদুকরকে উচিত-শিক্ষা দেওয়া সেই ব্যক্তি, আর কেউ নন। তিনি আমার জাদুদীক্ষাগুরু শ্রদ্ধেয় শ্রী সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়। যিনি একজন অসাধারণ জাদুকরের পাশাপাশিই ছিলেন অসামান্য ব্যক্তিত্ব। জানতেন ‘বাণ মারা’-র মতো তন্ত্রের সাধনাও। তবে শিক্ষা, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেও কোনোদিনই কারোর ওপর প্রয়োগ করেননি এ জিনিস। ক্ষমতার অধিকারী হলেও ছিলেন অতি পরিমার্জিত। আর তাই বোধ হয় জাদুর রঙ্গমঞ্চে সেরাদের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন তিনি।

জন্ম পূর্ববঙ্গের রামচর ফরিদপুর জেলার শিখরে ১৯১৫ সালে। বর্তমানে যা বাংলাদেশে। পিতা উষাকান্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন দর্শন এবং সংস্কৃতের সুপণ্ডিত এবং একজন আইনজীবী। সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন দক্ষ হস্তকুশলী জাদুকর। ছোটবেলায় এই জাদুর জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতেন তিনি। জাদুর প্রতি তাঁর আকর্ষণ এমনই ছিল যে যাযাবর শ্রেণীর মানুষ অর্থাৎ মাদারিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তাঁদের থেকে শিখেছিলেন অনেক কৌশল। শিখেছিলেন বাণ মারাও। নিজেকে বলতেন সূক্ষ্ম জগতের জাদুকর।

আরও পড়ুন
চোখের দিকে তাকালেই নিশ্চিত অজ্ঞান; জাদুকর এসি সরকার-কে নিয়ে শোনা যেত এমনই

তিনি পরবর্তী সময়ে জাদুকর প্রফেসর পুলকেশ চক্রবর্তী (যিনি ডঃ পুলকস্‌ নামে পরিচিত ছিলেন) ও জাদুকর প্রমথ গাঙ্গুলীর (জাদুজগতে যাঁর নাম ছিল প্রফেসর লি) থেকে ম্যাজিকের তালিম নেন। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল এন্ট্রান্স পর্যন্ত। 

সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায় একটু বোহেমিয়ান প্রকৃতির ছিলেন বলে মাদারিদের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কাল্লু মিয়াঁ, রহমতুল্লা সাহেব, তক্‌মাওয়ালা সাঁই। এছাড়াও রংবাজ ইউসুফ খাঁ ও ওয়াবেজ আলির হাতের খেলা দেখেছেন সামনে থেকে। তাঁদের থেকে শিখেছেন নানান কায়দাও। সেসব কথা কথাসাহিত্যিক অজিতকৃষ্ণ বসু (অ.কৃ. বসু) সুশীলবাবুর কাছে এই গল্প শুনে তাঁর বিখ্যাত বই জাদুকাহিনিতে লিপিবদ্ধ করেছেন। বাংলার এই নামী লেখক এবং ইংরাজি সাহিত্যিক, যিনি জাদুকে সাহিত্যের সম্মানের আসনে বসিয়েছিলেন, সুশীলবাবু তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। এমনকি, হাতের খেলার দৌলতে কবিশেখর কালিদাস রায়ের স্নেহধন্য হতে পেরেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন
কঙ্কাল বদলে যেত আস্ত নারীদেহে! বাংলার জাদু-জগতের পথিকৃৎ গণপতি চক্রবর্তীর খেল এমনই

সুশীলবাবু ছিলেন একজন স্বভাবকবি। মুখে মুখে ছড়া বলতেন। যখন খেলা দেখাতেন, তখন আকর্ষণ করার জন্য নানান মজার মজার ছড়া করতেন তিনি। এখন যেমন জাদুর মন্ত্র ‘হিলি গিলি’, ‘হিং-টিং-ছট’। তেমন তাঁর জাদুর মন্ত্র ছিল ‘আকোস-মাকোশ-ফাকোস’।

আরও পড়ুন
জাদু দেখাতে গিয়ে তরুণীর প্রাণ কেড়ে নিলেন পি সি সরকার? লন্ডন জুড়ে চাঞ্চল্য

সুশীলবাবু আধ্যাত্মিক জাদুও দেখাতেন। গীতার শ্লোকের ব্যাখ্যা করে তিনি ম্যাজিক দেখাতেন। বিভিন্ন মঠ, মন্দির এবং ধর্মপ্রতিষ্ঠান থেকে ম্যাজিক দেখানোর জন্য প্রায়শই আমন্ত্রণ আসত তাঁর কাছে। গৌড়ীয়মঠ থেকে তাঁকে ‘গীতা বিশারদ’ উপাধি প্রদান করা হয়েছিল। নবদ্বীপের বঙ্গীয় বিদ্যোৎসাহী সম্মেলনীর প্রাণপুরুষ হরিদাস তর্কসিদ্ধান্ত ওঁকে ‘জাদুবিদ্যা বিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর কবিতার হাত ছিল চমৎকার। পেয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের স্নেহাশিস এবং সান্নিধ্যও। ওঁর কাছে উত্তরায়ণ শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটরি সুধীরচন্দ্র কর, অনিলচন্দ্র চন্দ এবং রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও চিঠি আসত তাঁর কাছে। সেই চিঠি অক্ষত অবস্থায় এখনও রয়েছে আমার কাছে।

তিনি তিনটে রুমাল নিয়ে মজার মজার জাদুর সঙ্গে ছড়া কাটতেন। একটা খাঁচার ভিতর তিনটে রুমাল রেখে প্রথমে একটি রুমালকে ভ্যানিশ করে দিতেন। তার সঙ্গেই বলতেন,

“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, কেমনে আসে যায়।

ধরতে পারলে মন বেড়ি দিতাম তার পা’য়।

মন তুই রইলি খাঁচার আশে

খাঁচা যে তোর তৈরি কাঁচা বাঁশে,

কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে।

লালন কয়।

খাঁচা খুলে যে পাখি কোনখানে পালায়?”

গান আমি জানি না। ওস্তাদি গান বুঝি না। কিন্তু ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলির গান আমাকে পাগল করে দেয়। এই খাঁ-সাহেবের শেষ বয়সে পক্ষাঘাতে তাঁর গলা থেকে সুর চলে গিয়েছিল। তিনি শুধু কাঁদতেন আর বলতেন ‘হায় খোদা, তুমি কী জিনিস আমার গলা থেকে ছিনিয়ে নিলে!’ সুশীলবাবুর ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছিল। তবুও জীবনের শেষদিন অবধি জাদুবিদ্যার উপাসনা করে গেছেন তিনি। 

শেষ বয়সে এক জায়গায় সম্মাননার সময় সুশীলবাবু বলেছিলেন, “আমি একজন সামান্য জাদুকর। আপনারা আমাকে যে ভালোবাসা জানালেন। তাতে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। জীবনে আমি কিছুই করতে পারিনি। তাতে আমার দুঃখ নেই। যতদিন সুস্থ ছিলাম, এই দুটি হাতের খেলায় অনেক ভালবাসা পেয়েছি। আর দর্শকরাও আমাকে ভালবেসেছে। আমার মন যদি হাতকে বলে খেলা দেখাতে হাত কাঁপে। খেলা দেখাতে পারে না। এখন শুধু নিরালায় ঘরের কোণে একা আমার ইষ্ট দেবতাকে খেলা দেখাই। কারণ ঈশ্বর আমার কোনো ভুলত্রুটি ধরেন না। আমার জাদুই তপ, জাদুই জপ, জাদুই আমার খেয়াপাড়ের কড়ি। আমার জীবন শেষ হয়ে আসছে। যাবার আগে বড় ভালবাসা পেলাম প্রকাশ্য সভায়। এর জন্য কৃতজ্ঞ সবার কাছে। তরুণ জাদুশিক্ষার্থীদের বলি হাতের খেলাই জাদুর আসল খেলা। নিষ্ঠার সঙ্গে সাধনা করলে অবশ্যই সুফল পাবেই পাবে।”

হৃদরোগে অসুস্থ হয়ে ভর্তি ছিলেন ভাঙড় হাসপাতালে। তবে বাড়িতে ফিরে এলেও অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি একেবারে। বাড়ি থেকেই চলত চিকিৎসা। কলকাতার বিখ্যাত চিকিৎসক কার্ডিওলজিস্ট ডঃ পি.কে. সেন নিজে তাঁকে দেখে যেতেন বাড়িতে। তিনি এতটাই শ্রদ্ধা করতেন গুণীজন সুশীলবাবুকে। শেষ বয়সে তাঁর শরীরের অবস্থা যখন একেবারেই ভালো নেই, খবর পেলেন তিনি। খবর পেলেন জুনিয়র পিসি সরকারও। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে নিজেও হাজির হয়েছিলেন পিসি সরকার জুনিয়র। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তখন সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়। পিসি সরকার মজার ছলেই তাঁকে বললেন কিছু খেলা দেখাতে। তিনি অনুরোধ ফেললেন না অনুজ সহশিল্পীর। মৃত্যুশয্যায় শুয়েই খেলা দেখালেন সুশীলকুমার। তার কিছুদিন পরই ২৯ ডিসেম্বর ১৯৮৫ সালে এই জাদুজীবনের মায়া ত্যাগ করেই তিনি চলে গেলেন সকলকে ছেড়ে...

(অনুলিখন – শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়)

Powered by Froala Editor

More From Author See More