চোখের দিকে তাকালেই নিশ্চিত অজ্ঞান; জাদুকর এসি সরকার-কে নিয়ে শোনা যেত এমনই

লোকজনের মধ্যে চাউর হল, জাদুকর একটা পুরো গিটার গিলে ফেলেছেন। অনেকটা অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো। সেই জনশ্রুতি নিয়েই বেশ তোলপাড় উঠল কলকাতায়। তবে ঘটনাটা ঘটেছিল একটু অন্যরকমভাবেই। মঞ্চে জাদুকর বাক্স থেকে একটা গিটার বার করে দেখালেন। তারে ধ্বনিও তুললেন। তারপর বাক্সটি খালি দেখিয়ে গিটারটি আবার বাক্সবন্দি করে ফেললেন তিনি। তারপর বাক্সের এক কোণায় একটা কলের স্টপার জুড়ে নিলেন জাদুকর। তার তলায় একটা কাচের গ্লাস ধরে স্টপার খুলতেই রঙিন পানীয়তে ভরে গেল সেই গ্লাস। সেই রঙিন পানীয় এক ঢোঁকে খেয়ে ফেললেন তিনি। তারপর বাক্স খুলতেই দেখা গেল গিটারটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। অর্থাৎ গিটারটি তরল হয়ে তাঁর পেটে চলে গেছে। জাদুকর তারপর গলার বাইরে আঙুলের টোকা দিতেই ফুটে উঠল গিটার বাদনের সুর।  

এমন ভাবেই দর্শকদের অবাক করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন জাদুকর এসি সরকার। পুরো নাম অতুলচন্দ্র সরকার। তবে সারা বিশ্বের কাছে তাঁর পরিচয় ওই ‘এসি সরকার নামেই’। ম্যাজিকের মঞ্চে নামের বানান লিখতেন ‘AC Sorcer’। জন্ম টাঙ্গাইলের ময়মনসিংহ জেলার আশেকপুর গ্রামে ১৩ নভেম্বর ১৯২৯ সালে। বাবা ভগবানচন্দ্র সরকার। মাতা কুসুমকামিনী দেবী। অতুলচন্দ্র সম্পর্কে জাদুসম্রাট পিসি সরকারের নিজের ছোটোভাই। 

সারা বিশ্ব বেশ কয়েকবার ঘুরেছেন। আবিষ্কার করেছেন বহু খেলাই। জাপানের মানুষ ওনাকে ‘গিটার ভয়েস জাদুকর’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বেলজিয়ামে আখ্যা পেয়েছিলেন ‘ম্যাজিক প্রিন্স অফ ইন্ডিয়া’। কলকাতার জাদুসংস্থা এঁকে ‘জাদুরত্নাকর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তবে এও ঠিক জাদুসম্রাট না থাকলে জাদুরত্নাকর হতে পারতেন না তিনি।  

ছোটোবেলায় প্রথম মাদারি এবং বেদে-বেদেনীদের খেলা দেখে জাদুর প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। পরে বড়দাদা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ম্যাজিক দেখাতেন। সেখান থেকেই ম্যাজিকের প্রতি একটা অন্যরকম ভালবাসা জন্মায়। পড়াশোনায় বেশ ভালোই ছাত্র ছিলেন এসি সরকার। বরাবরই ঝোঁক ছিল বিজ্ঞানের দিকে। সায়েন্স নিয়েই গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন। তবে অতুলচন্দ্রের ভিতর বড়ো হওয়ার একটা প্রবল বাসনা থাকায় সবসময়ই সাহেবদের মত চাল-চলন ছিল তাঁর। আচরণে মিশে থাকত সাহেবিয়ানা। কথা বলার ভঙ্গি, উচ্চারণেও ধরা পড়ত বিলিতি কায়দা। পড়াশোনায় বন্ধুদের সঙ্গে একপ্রকার প্রতিযোগিতাই করতেন তিনি। পরখ করে দেখতে চাইতেন, কে ওঁকে হারাতে পারে।

লন্ডনের ঐতিহাসিক টাওয়ারে অনুষ্ঠিত একটি শিশু মজলিসে যাদুর খেলা দেখাচ্ছেন এসি সরকার

 

প্রথম জীবনে চাকরি করতেন। তারপর দাদা পিসি সরকারের সঙ্গে বিশ্বভ্রমণ করেন। পরবর্তী সময়ে নিজে দল করে বেশ কয়েকবার বিশ্বভ্রমণ করেছেন তিনি জাদুর পতাকা নিয়ে। ব্যক্তিগত জীবনে খুবই রসিক মানুষ হওয়ায়, তাঁর জাদু প্রদর্শনীর ভঙ্গি ছিল খুবই নাটকীয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য খেলাগুলির মধ্যে ছিল আলট্রা-প্রেডিকশন, তাসকন্দ ও বিশ্বশান্তি, নেহেরুজির স্বপ্ন, কাশ্মীর হামারা হ্যায়, দেশের ডাক, রকেট ইল্যিউশন ইত্যাদি। অনেকগুলি ভাষাও জানতেন। জাদুপ্রতিভার পাশাপাশিই তিনি ছিলেন একজন ভালো সাহিত্যিক ও ছড়াকার। নানান রকম মজার মজার বিষয় নিয়ে গল্পও লিখতেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। এছাড়াও ‘চাঁদমামা’তে রহস্য মাখানো দারুণ দারুণ গল্প লিখতেন তিনি। ‘যুগান্তর পত্রিকা’-য় ‘রোজনামচা’-য় ছড়া লিখতেন তিনি। 

আরও পড়ুন
কঙ্কাল বদলে যেত আস্ত নারীদেহে! বাংলার জাদু-জগতের পথিকৃৎ গণপতি চক্রবর্তীর খেল এমনই

কয়েকটি সিনেমাতেও ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন তিনি। অজয় করের ‘কাঁচ কাটা হীরে’, গুরু দত্তের হিন্দি সিনেমায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ‘ডিটেক্টিভ’ সিনেমায় প্রদীপকুমারের ডামি হয়েছিলেন তিনি। তখনকার সময়ের বোম্বের নানান নামকরা শিল্পীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। শিখিয়েছেন ম্যাজিকও। ম্যাজিক নিয়ে লিখেছেন মোট এগারোটি বই। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আধুনিক ম্যাজিক’, ‘ম্যাজিকের কারসাজি’, ‘দেশবেড়ানি ছড়া’, ‘ম্যাজিক ও ভোজবাজি’, ‘আনন্দচুমকী উপন্যাস’ (জাদুকরের পূর্ণাঙ্গ জীবনী) প্রভৃতি।

জাদুকর অতুলচন্দ্র সরকারের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ

 

বহু বাঙালি গুণী মানুষের আশীর্বাদ পেয়েছেন। পেয়েছেন সান্নিধ্যও। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কবি নরেন্দ্র দেব, স্বপন বুড়ো, মৌমাছি, সুনির্মল বসু প্রমুখের খুবই কাছের মানুষ ছিলেন এসি সরকার। তিনি গলা, নাকে হাতের বুড়ো আঙুলের টোকা দিয়ে অসাধারণ সুন্দর গিটার বাজাতেন। যা না শুনলে বিশ্বাস করাই কঠিন, যে গলা দিয়েই বেরোচ্ছে বাদ্যযন্ত্রের সুর। ইনি কণ্ঠের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তুলতে পারতেন গিটার কিংবা সানাইয়ের সুর।

আরও পড়ুন
জাদু দেখাতে গিয়ে তরুণীর প্রাণ কেড়ে নিলেন পি সি সরকার? লন্ডন জুড়ে চাঞ্চল্য

তাঁর বাড়ি ‘ম্যাজিক ভিলা’ ছিল ১২/৬ সেলিমপুর রোড, ঢাকুরিয়া কলকাতায়। ১৯৫১ সালে তৈরি করেন তাঁর এই বাড়ি। সেখানেই চার সন্তান ও স্ত্রী-র সঙ্গে বাস করতেন। তিন কন্যা এবং এক পুত্র সন্তান। স্ত্রী-র নাম আলোরানী সরকার। জাদুকরপুত্র বর্তমানে একজন প্রথম সারির চিকিৎসক, একজন অঙ্কোলজিস্ট। বছরখানেক শুরুতে ম্যাজিক দেখালেও পরে আর কাজের চাপেই ম্যাজিককে বেছে নেওয়া হয়নি পেশা হিসেবে।

জাদুকর এসি সরকার সবসময়ই কালো চশমা পরে ম্যাজিক দেখাতেন। তখনকার ম্যাজিকের স্টেজ সাজানো হয় উজ্জ্বল ফ্লাডলাইটে। আর সেই তীব্র আলোতেই ক্ষতি হয়ে যায় চোখের। চিকিৎসকের পরামর্শে তাই এমন চশমা ব্যবহার করতেন সবসময়। তবে তাঁর এই চশমা নিয়েই তখন তৈরি হয়ে গিয়েছিল একটি মিথ। তাঁর চোখের দিকে যিনিই তাকাবেন, তিনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। তাই এসি সরকার এমন চশমা পরে থাকেন। এমনই কথা ছড়িয়ে পড়েছিল বহু মানুষের মধ্যে।

বিখ্যাত ফরাসি সংবাদপত্র ‘প্যারী নর্মান্তী’-তে প্রকাশিত মঁসিও বিঁদন্সের অঙ্কিত এসি সরকারের কার্টুন 

 

আরও পড়ুন
পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বারবার পালিয়েছেন অগ্নিযুগের জাদুকর ‘রয় দ্য মিস্টিক’

১৯৮৪ সালের ১৪ জুন জীবনাবসান হয় তাঁর। রেখে যান তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিগুলিকে আর দর্শকদের দিয়ে যান হাজার হাজার বিস্ময়ের ঝুলি। বাংলার প্রথম সারির জাদুকরদের কথা যখনই আসবে, তখনই উচ্চারিত হবে তাঁর জাদুপ্রতিভার কথা। যে কথা, মুগ্ধতা নিজের মত করে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন কবি সুনির্মল বসুও।

“সাবাস্‌ এসি সরকার ভাই— করলে বাজিমাত

তুর্কী-নাচন নাচিয়ে সবায় করলে কূপোকাৎ।

গলায় বাজাও গিটার-সানাই

হরেক জাদু তোমার জানাই।

অসম্ভবের ভেল্‌কী তোমার দেখালে নির্ঘাৎ

দেশ-বিদেশের গুণীর সভার

‘চক্ষুচড়ক’ করলে সবার

ইউরোপের তামাম জনে ধরালে মৌতাত,

বিস্ময়েতে বিশ্ব মাতাও ক্যায়া বাত ক্যায়া বাত।”    

(অনুলিখন – শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়)

Powered by Froala Editor

More From Author See More