হল ঘরে পিন-পড়া নিস্তব্ধতা। মঞ্চের উল্টোদিকে বসে থাকা দর্শকরা তাকিয়ে অধীর আগ্রহে, প্রতীক্ষা জাদুখেলা শুরু হওয়ার। আর তাদের উল্টোদিকে মঞ্চের ওপরে আমি। আমার ভেতরেও চলছে এক অন্য প্রহর গোনা। কারণ আর পাঁচটা অনুষ্ঠানের মতো নয় আজকের এই খেলা দেখানো। আজকের এই প্রদর্শনী এক অন্য চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কীভাবে শুরু করা যায় ম্যাজিকের শো?
ভাবলাম, প্রথম দর্শকদের সঙ্গে খানিকটা কথা বলে, তারপর শুরু হোক জাদু। সেই সূত্রেই তাদের বললাম, আমরা সকলেই অল্প-বিস্তর জাদু জানি। তবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর হলেন ঈশ্বর। কিছু বোঝার আগেই দর্শকাসন থেকে উঠে দাঁড়াল এক ব্যক্তি। চেঁচিয়ে উঠে ফেটে পড়ল রাগে, “মিথ্যে কথা!” খেলার শুরুতেই এমন ঘটনা বেশ খানিকটা চাপে ফেলে দিল আমায়। তবে কি গুরুতর ভুল বলে ফেললাম কিছু?
যখনকার কথা বলছি তখনও ম্যাজিক দেখাই আমি। ছাড়িনি মঞ্চজীবন। তবে ম্যাজিকই যে একমাত্র পেশা, তেমন নয়। বরং নেশাই বলা চলে। দিনটা ছিল ১৯৭৮ সালের ১৮ জুলাই। আমন্ত্রণ এসেছিল তারও বেশ কিছুদিন আগে। পার্ক সার্কাসের কাছেই গোবরায় এক হাসপাতালে দেখাতে হবে খেলা। ওই যে বললাম, ম্যাজিক হল নেশা। তাই সে আমন্ত্রণে একবাক্যেই রাজি না হওয়া ছাড়া উপায় কী?
তবে আগে থেকেই জানা ছিল ম্যাজিক শোয়ের দর্শকরা হবে অপ্রকৃতিস্থ। মানে? ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলা যাক। গোবরার সেই হাসপাতাল আসলে মানসিক রোগীদের। আর তাদেরকেই খেলা দেখানোর কথা আমার। ফলে এক দিকে যেমন অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যই উদগ্রীব হয়ে ছিলাম। তেমনই অন্যদিকে এই অপ্রকৃতস্থ বন্ধুদের মনোরঞ্জন করব কীভাবে, সেই চিন্তাই ঘুরছিল মনের মধ্যে। তাদের মনস্তত্ত্ব তো আমার জানা নেই। তবে?
যাই হোক, শেষমেশ পৌঁছানো গেল সেই হাসপাতালে। গাড়ি থেকে গেটের সামনে নামতেই এগিয়ে এসে শুভেচ্ছা জানালেন দু’জন চিকিৎসক। তাঁদের সঙ্গেই এগতে লাগলাম ভেতরের দিকে। পিছনে আমার দুই সহকারী নিয়ে আসছে আমার ট্রাঙ্ক। লাল সুরকির পথ। দু’দিকে সবুজ ঘাসের গালিচা।
যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম, পথের দু’দিকে ছড়িয়ে রয়েছে হাসপাতালের অপ্রকৃতিস্থ বাসিন্দারা। কেউ শীর্ষাসন করছে মাথা নিচে, পা ওপরে করে। কেউ বকে যাচ্ছে অনর্গল। কেউ কেউ মূকাভিনয় করছে, মনে মনে হেঁসে চলেছে অবিরাম। নিজের মনেই। একজন আমাদের দেখে তার বন্ধুকে বলে উঠল, “ওই দেখ। আমাদের সঙ্গে আরও তিনজন যোগ হল। এখন আমরা পনেরো জন...”
আরও পড়ুন
মানুষের হাড় দিয়েই তাক-লাগানো ভেল্কি, কলকাতা ভুলেছে মাদারি জাদুকর রহমতুল্লাকেও
ততক্ষণে হাসপাতালের সুপার এসে গেছেন আমাদের মধ্যে। অভিবাদন জানিয়ে দু’-চার কথা বলছেন আমার সঙ্গে। এক ব্যক্তি এসে এর মাঝেই বলে গেল, ‘নমস্কার, আমি হারাধন খাসনবীশ’। তার পোশাক, আচার-আচরণ দেখে বুঝলাম এই হাসপাতালেরই কোনো কর্মচারী সে। খানিকক্ষণ বাদেই সে ফিরে এসে আবার বলল, ‘ভালো আছেন? আমি ভজা!’
গলার স্বর আর চেহারা দেখেই অবাক হয়ে গেলাম আমি। এই ব্যক্তিই তো এক্ষুনি অন্য নাম বলে গেলেন আমাকে! তবে? সুপার জানালেন, ওই ব্যক্তিও একজন রোগী। নিজের নাম-পরিচায় খানিক বাদে বাদেই সব ভুলে যায় সে। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে অ্যামনেশিয়া।
আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে এক আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন সুপার। আমি দাঁড়িয়ে চারিদিকের পাঠক্রম নিচ্ছি তখন। আমাকে একা পেয়েই এগিয়ে এল একজন। করুণ কণ্ঠে বলল, “এরা আমাকে পাগল বলে আটকে রেখেছে। কিন্তু এখন আমি স্বাভাবিক, সুস্থ। আপনি যদি ডাক্তারবাবুকে গিয়ে একটু বলেন, তবে আমাকে ছেড়ে দেয় এরা। আপনি একটু গিয়ে বলবেন ডাক্তারবাবুকে?”
আরও পড়ুন
জাদু করে মঞ্চে ‘হাজির’ করতেন নিরুদ্দেশ নেতাজিকে, চোখ বেঁধে বাইক চালিয়েছেন কলকাতার রাস্তায়
এমন কাতর অনুরোধে ‘না’ করি কীভাবে? জানালাম, অবশ্যই বলব। এমন করুণ আর্তিতে যেন কেঁদে উঠল মনটা। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও একটা অস্বস্তি হতে লাগল। সুপারের দিকে এগোলাম তাই বাধ্য হয়েই। দু’পা বাড়াতেই পিছন দিক থেকে সজোরে এক লাথি। চমকে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে সে বলল, “সব শালাই বলে আমি বলব। কিন্তু কেউই আর বলে না। তাই আগে থেকেই লাথিটা মেরে রাখলাম।”
যাই হোক মঞ্চের কাছে গিয়ে সুপারকে অনুরোধ করলাম খানিকটা সময় চেয়ে। খেলাগুলোকে যে গুছিয়ে নিতে হবে আমায়। দরজায় একজন দারোয়ান রেখে উনি চলে গেলেন। তবে তার মধ্যেও মাঝেমাঝেই গ্রিনরুমে ঢুকে পড়ে এক-একজন। কেউ বলে, “স্যর আমি এখানেই আছি, যদি কিছু দরকার পরে আমাকে জানাবেন।” তো কেউ বলে “একটা বিড়ি হবে?”
আরও পড়ুন
মৃত্যুশয্যাতেও ফেরাননি পিসি সরকারকে, হাসপাতালে শুয়েই জাদু দেখালেন সুশীলকুমার
এর মধ্যেই যথাসম্ভব গুছিয়ে নেওয়া আমার সরঞ্জাম। খানিকক্ষণ বাদেই হলঘর ভরে উঠল দর্শকে। আর খেলা দেখানোর শুরুতেই সেই মুহূর্ত। যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এই গল্পের। সেই দর্শক ‘ঈশ্বর’-এর কথা বলতেই বেজায় চটে গেলেন, “মিথ্যে কথা। আমি মোটেই জাদুকর নই।” সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার তাকে বুঝিয়ে বললেন আমি অন্য ঈশ্বরের কথা বলছি।
খেলা শুরু হল পরিস্থিতি খানিক শান্ত হতেই। লাল রুমালকে নীল করলাম। খালি কৌটো থেকে পায়রা উড়িয়ে দিলাম। খালি কলসি থেকে গ্লাসে ঢাললাম জল। এমনই সব খেলা চলছে আর অপ্রকৃতিস্থ বন্ধুদের থেকেই ভেসে আসছে হাততালি। সঙ্গে থেকে থেকে কিছু মন্তব্যও।
কিছু রঙিন কাগজ হাতে নিয়ে খেলা দেখানোর আগে ‘এগুলো কী?’ জিজ্ঞেস করতেই একজন বলে উঠল, “খেলা দেখাতে এসেছে, আর নিজেই জানে না এগুলো কী!” তার পাশে বসা আরেক বন্ধু তাকে বোঝাল, “আরে দূর বোকা, তোকে তো পরীক্ষা করছে...”
এবার একটা রুমাল নিয়ে খেলা দেখাচ্ছি। সেটা হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে ছড়ি করে ফেললাম। সবার উচ্ছ্বাস দেখে বুঝলাম মনে ধরেছে খেলাটা। একজন চেঁচিয়ে বলল, “এবার ওটাকে অন্য কিছু করতে পারবেন?” আমি সেটাতে হাত বোলাতেই ফুলের ঝাড় হয়ে গেল একটা।
খেলা দেখানোর আগে বুকের মধ্যে যেমন দুরু দুরু চলছিল। সেই ভাবটাই যেন শেষে আর নেই। এক অদ্ভুত আনন্দ। কারণ খেলা দেখার পর সেই অপ্রকৃতিস্থ বন্ধুরাই হাজির হয়েছে ফুলের তোড়া নিয়ে। অনেকে এসে জানিয়ে যাচ্ছে অভিনন্দনও।
এবার ফেরার পালা। খেলার সরঞ্জামগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি ট্রাঙ্কে। এমন সময় একজন এসে বলে, “আমার এই পাঁচ টাকার নোটটা দশটাকার নোট করে দিতে পারো?” পকেটে দশ টাকার নোট ছিলই। ফলে অসুবিধা হল না সেই নোটটাকে হাতের কায়দায় নিমেষে বদলে দিতে। বেজায় খুশি হল সে। তাকে বললাম এবার ওই দশটাকার নোটটা দিতে। আবার ওটাকে পাঁচ টাকায় বদলে দিই। কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না সে। বলল, পাঁচ টাকার থেকে দশ টাকা ভালো। বেশ কী আর বলার! মনে মনে বললাম, পাঁচ টাকা গচ্চা গেল আমার!
ফেরার আগে ওখানকার ডাক্তাররা আমাকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালের প্রদর্শনী কক্ষে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন বিভিন্ন ধরণের হাতের কাজ। সেসব দেখলে বিশ্বাসই হয় না এই আশ্রমের আবাসিকদের হাতেই তৈরি হয়েছে সেগুলো। মনে হবে বিখ্যাত কোনো শিল্পীদের হাতের কাজ। অপ্রকৃতস্থ বন্ধুরা যতটা না আমার ম্যাজিক দেখে বিস্মিত হয়েছিল, তার থেকে খানিকটা বেশিই জন্মেছিল আমার বিস্ময়।
‘উন্মাদ’ বলে যারা পরিচিত, তাদের চিন্তা, ভাবনা, বুদ্ধি কোন পথ দিয়ে চলে তা আজও জানা নেই। জানা নেই তাদের রুচি ও মেজাজের। তবে সেদিনের পর তাদের ব্যাপারে আমার ধারণা পাল্টে গিয়েছিল একেবারেই। তাদের চিন্তা-ভাবনা শৈলী দেখা বুঝেছিলাম, এক অন্য মহাজাগতিক জগত তৈরি করে রাখে তারা। যার অলৌকিক ক্ষমতা আমাদের স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধির বাইরে। তাই হয়তো রামপ্রসাদও গান বেঁধেছিলেন। বলেছিলেন, “দে মা, আমায় পাগল করে...”
অনুলিখন – শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor