কলকাতার ইম্পেরিয়ল রেস্তোরাঁয় সপার্ষদ হাজির হয়েছেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক। অবশ্য তখন মুখ্যমন্ত্রী পদটিকেই অভিহিত করা হত প্রধানমন্ত্রীকে। সেখানেই হাজির হয়েছেন এক বাঙালি জাদুকর। হক সাহেবকে নিজের ‘ম্যাজিক’ দেখাবেন। রাজিও হলেন তিনি। জাদুকরের কথামতো, সাধারণ একটা কাগজের টুকরোয় কিছু লিখলেন। সইও করলেন। বাকি মন্ত্রীরা যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরাও তার তলায় সই করলেন। ঠিক তারপরই, চিচিং ফাঁক! জাদুকরের মন্ত্রবলে, সেই সামান্য কাগজ হয়ে গেল পদত্যাগপত্র! ফজলুল হক প্রধানমন্ত্রিত্ব হারালেন, আর সেই মুহূর্তের জন্য সিংহাসনে বসলেন সেই বাঙালি জাদুকর, প্রতুল চন্দ্র সরকার! পরবর্তীকালে ইতিহাস যাকে চিনবে পি সি সরকার সিনিয়র হিসেবে।
নিজের ইন্দ্রজালে গোটা বিশ্বের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন এই মানুষটি। নিখাদ ভারতীয় পোশাকে, পাগড়ি পরে একজন স্রেফ ধাঁধিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন সামনের জনতাকে, এমন দৃশ্য তার আগে কি কেউ দেখেছে সেভাবে? মনে করা যায় না। পি সি সরকার এইভাবেই বিজ্ঞান এবং যুক্তির মিশেলে আমাদের ম্যাজিক চেনালেন।
ছোট থেকেই ম্যাজিকের প্রতি উৎসাহ ছিল প্রতুল সরকারের। স্কুলে পড়তে পড়তেই হাত মকশো শুরু। সেইসময়ই পেয়েছিলেন কিংবদন্তি জাদুকর গণপতি চক্রবর্তীকে, যাঁকে বাংলার আধুনিক জাদুবিদ্যার জনক বলা হয়। তবে এসবের পাশাপাশি চলছিল পড়াশোনাও, কোনদিন সেইদিকে ফাঁকি দেননি তিনি। অঙ্ক নিয়ে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেই মনস্থির করে ফেলেন তিনি। ম্যাজিকই হবে তাঁর এক ও একমাত্র দুনিয়া।
নিজের জীবদ্দশায় বহু দুঃসাহসিক ম্যাজিক দেখিয়েছেন তিনি। অনেক ম্যাজিক তাঁর একান্ত নিজেরই আবিষ্কার। ‘ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া’, ‘ফ্লটিং লেডি’, ‘এক্স-রে ভিশন’ ইত্যাদি বিখ্যাত ম্যাজিকগুলো তো রয়েইছে। সেই সঙ্গে রয়েছে একটি আস্ত মানুষকে দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়ার ম্যাজিক। যা নিয়ে ১৯৫৬ সালে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল আমেরিকায়। একজন তরুণীকে সবার সামনে করাত দিয়ে, মঞ্চের মধ্যেই দুইভাগ করে দিলেন এক ভারতীয় জাদুকর! এ কি ধরনের নৃশংসতা! এর আগে এইরকম ম্যাজিক তো দেখেনি কেউ। ব্যস, যাকে বলে আলোড়ন পড়ে গেল। পরেরদিনই খবরের কাগজে হেডলাইন হলেন তিনি। তবে পি সি সরকার সিনিয়রের শো-এর টিআরপি এক বিন্দুও কমেনি। তারপর থেকে সমস্ত শো-ই হাউজফুল হয়েছিল তাঁর।
ম্যাজিক আর বিজ্ঞান— এই দুটোকে কখনই আলাদা করে দেখেননি প্রতুলবাবু। এমনকি, প্রাচীনকালের কিছু ম্যাজিকের মূল সূত্রও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর এই অবদানকে সম্মান জানিয়েছে বিশ্বও। পেয়েছেন ম্যাজিকের অস্কার ‘দ্য স্ফিংক্স’ পুরস্কার। ভারত সরকারের থেকে পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মানও। জাপান, আমেরিকা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড— ৭০টিরও বেশি দেশে জাদু দেখিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে নিয়ে গেছেন ভারতের ঐতিহ্যকে, সংস্কৃতিকে। নিজের পোশাকের মধ্যেও সবসময় সেটা বহন করতেন তিনি।
জীবনের অধিকাংশ সময় মঞ্চেই কাটিয়েছেন পি সি সরকার। এমনকি, মৃত্যুও এসেছিল সেই মঞ্চেই। ১৯৭১ সালে জাপানে জাদু দেখাতে দেখাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন পি সি সরকার সিনিয়র। মারা যান সেখানেই। সশরীরে না থাকলেও, তাঁর সৃষ্ট ম্যাজিকে আজও মোহিত হই আমরা। ম্যাজিকের পাশাপাশি চিনতে শিখি বিজ্ঞানকেও।
Powered by Froala Editor