সাধারণ মানুষের কোনো সমস্যাকে ব্যক্তিগতভাবে অনুভব না করতে পারলে, তার সমাধানই বা দেওয়া যায় কীভাবে? সম্প্রতি এমনটাই অকপট স্বীকার করলেন মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি এন আনন্দ ভেঙ্কটেশ। সমকামী সম্পর্কের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবগত না হয়ে মামলার রায় দেবেন না জানিয়ে দিলেন তিনি। এমনকি সমকামিতার বিষয়ে মনোবিদের কাছে রীতিমতো ক্লাস নিচ্ছেন এন ভেঙ্কটেশ।
মাদুরাইয়ের এক সমকামী দম্পতি চেন্নাই থেকে পালিয়ে এসেছিলেন বছর খানেক আগে। সন্তানের সুরক্ষা চেয়ে থানায় ‘মিসিং ডায়েরি’ করেছিলেন তাঁদের বাবা-মা। পরবর্তীকালে সেই মামলাই গড়ায় আদালত পর্যন্ত। সেই মামলাই বিগত বর্তমানে বিচারপতি আনন্দ ভেঙ্কটেশের এজলাসে।
উদারপন্থী মানসিকতার ভেঙ্কটেশ প্রথম থেকেই গতানুগতিক বিচারধারার বাইরে গিয়েই দেখছেন এই মামলাটিকে। এর আগেও শুনানিতে দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। সমকামী দম্পতি এবং তাঁদের অভিভাবকদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়াতে, উপদেশ দিয়েছিলেন কাউন্সিলিং-এর। আর এবার নিজেই খোদ সমকামিতার পাঠ নিতে, তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলেন মনোবিজ্ঞানী বিদ্যা দিনকরনের কাছে। তাঁর অভিমত, মামলার রায় আসা উচিত হৃদয় থেকে, মস্তিষ্ক থেকে নয়।
মামলাকারী অভিভাবকদের অভিমত, সমকামিতা সমাজের পক্ষে বিভ্রান্তিকর। এমন সম্পর্কে থাকলেও, তাঁদের সন্তানরা যেন অবিবাহিত থাকেন— সেই আবেদনই করেছেন তাঁরা। তবে ভেঙ্কটেশ দুঃখের সঙ্গেই জানিয়েছেন, বিষয়টি এখনও সমাজের কাছে ট্যাবু। সেখান থেকে বেরিয়ে এসেই পর্যালোচনা করা উচিত অভিভাবকদের। ফলত নতুন করে আদেশ দেওয়া হয়েছে দু’পক্ষের কাউন্সিলিং-এর।
আরও পড়ুন
দৃষ্টিহীনদের কোভিড-চিকিৎসা এবং টিকাকরণে ভরসা আদালতই?
তবে শুধুই কি ভেঙ্কটেশ? তাঁর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক একটা দিক। কিন্তু গোটা দেশের ক্ষেত্রেই আইনি ব্যবস্থার পরিকাঠামোই কি এমন হওয়া উচিত ছিল না? সেই কথাই জানালেন ‘প্রান্তকথা’ সংস্থার কর্ণধার বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়, “নালসা এবং ৩৭৭-এর জাজমেন্টেই বলা আছে, রায়ের ইমপ্লিমেন্টেশন যথেষ্ট হবে না যতক্ষণ এই বিষয়ে সকলের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে। সেটার মধ্যে বিচারকরাও তো পড়েন। সেটা করণীয়। এক্ষেত্রে উনি উদ্যোগী হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে, সেটা খুবই ভালো বিষয়। কিন্তু ওঁকে উদ্যোগী হতে হয়েছে এটা দুঃখজনক। এই ক্লাস, এই ওয়ার্কশপ আসলে সকল স্তরে দরকার ছিল। যাঁরা ক্ষমতায় আছে, তাঁরা তো বিভেদ বা বিভাজন ব্যতিরেকে সাধারণ মানুষের সাহায্য করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের মানুষের একটা ক্রাইসিস এসে পড়ছে, ততক্ষণ তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। কেন হাইকোর্টগুলোতে ন্যাশনাল, স্টেট বা ডিসট্রিক্ট লিগাল সার্ভিস অথোরিটি এই ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন না, সেটাই সবথেকে বড়ো প্রশ্ন।”
আরও পড়ুন
অজাত সন্তানকেও সমাধিস্থ করার অধিকার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ দম্পতি
বাপ্পাদিত্যবাবু মনে করিয়ে দিলেন গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিটার কথাই। সাম্যাধিকার। কিন্তু সেটা কি সত্যিই রক্ষিত হচ্ছে সার্বিকভাবে? যদি না প্রতিটা মানুষের সমস্যাগুলি নিয়ে বিস্তারিত চর্চা হয়, তাহলে তো নিশ্চিতভাবেই ফাঁক থেকে যাওয়ার কথা সুশাসনে। আর সেটাই হচ্ছে বাস্তবে। বিচার ব্যবস্থার মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই ফুটে উঠছে বৈষম্যের ছাপ। তবে এই গোটা ব্যবস্থাটার যে পরিবর্তন দরকার, সেই কথাই মনে করিয়ে দিল ভেঙ্কটেশের ব্যক্তিগত উদ্যোগ। এটুকুই আশা করা যায়, আগামীতে প্রতিটা ক্ষেত্রেই সংবেদনশীলতা এবং সহানুভূতির আঙ্গিকেই দেখা হবে প্রত্যেক মানুষের সমস্যাকে। আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ দেখিয়ে দিলেন বিচারপতি এন ভেঙ্কটেশই…
আরও পড়ুন
সমাধিফলকে নিজের নাম! আদালতের দ্বারস্থ মহিলা
Powered by Froala Editor