মাদাম ‘এক্স’ এবং একজন পোর্ট্রেট আঁকিয়ের পুনর্জন্ম

ঘটনাস্থল একটি স্যালঁ বা বার্ষিক প্রদর্শনী। সবে প্যারিস পশ্চিমী শিল্পকলার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে প্রায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ১৮৮৪ সালের এক সন্ধ্যেবেলা। গমগম করছে ‘প্যারিস স্যালঁ’, অর্থাৎ ২১৬ বছর অতিক্রম করে ২১৭-তে পদার্পণ করা তৎকালীন বিশ্বের অন্যতেম শ্রেষ্ঠ চিত্র প্রদর্শনী।  তখন প্রায় সব চিত্রকরেরই স্বপ্নের গন্তব্য ছিল এটি। সেবারও অনেকেই সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু প্রায় সবারই নজর আটকে যাচ্ছিল একটিই ছবিতে। একটি পূর্ণাবয়ব ছবি। ক্যানভাসে অদ্ভুত এক দক্ষতা প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু দর্শকরা যেন ঠিক গ্রহণ করতে পারছেন না ছবিটিকে! যেমন অসামান্যা রূপসী সেই নারী তেমনই দক্ষ চিত্রকর।

যিনি ছবিটি এঁকেছিলেন তিনি ছিলেন জন সিঙ্গার সার্জেন্ট। উনি ১৮৭৪ সালে আমেরিকা থেকে প্যারিসে আসেন এবং প্রখ্যাত শিল্পী কার্লো দ্যুরঁর তত্ত্বাবধানে শিল্পচর্চা শুরু করেন। খুব তাড়াতাড়িই শিল্পীমহলে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তাঁর অধ্যাবসায় ও প্রতিভার জোরে। সার্জেন্টের প্যারিস আগমনের কয়েকবছর আগেই ১৮৬৭ সালে বিধবা মায়ের হাত ধরে মাত্র ৮ বছর বয়সে আমেরিকার নিউ অর্লিয়ঁস থেকে প্যারিসে আসেন ভার্জিনি এমেলি অ্যাভেনো। তারপর ওখানেই পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে তাঁর অসামান্য সৌন্দর্যের জন্য আস্তে আস্তে শহরের শিল্পীদের কাছে জনপ্রিয় এবং মডেল হিসেবে দুর্লভ হয়ে ওঠেন ভার্জিনি। ফরাসি সমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ভার্জিনি এমেলির আভিজাত্য এবং ভাবগাম্ভীর্যকে ক্যানভাসে ধরতে বহু চিত্রকরই অনেক কাঠখড় পোড়াতে রাজি ছিলেন। 

ওদিকে বিত্তবান দেল কাস্তিলো পরিবারের সঙ্গে এমেলির পরিচয়ের কথা জানতে পেরে  সার্জেন্ট তাঁর বন্ধুবর বেন কাস্তিলোকে চিঠিতে লেখেন - "'I have a great desire to paint her portrait and have reason to think she would allow it and is waiting for someone to propose this homage to her beauty. If you are `bien avec elle` and will see her in Paris, you might tell her that I am a man of prodigious talent" (bien avec elle শব্দগুচ্ছের অর্থ হল কোনো ব্যাপারকে কারো কাছে সহজভাবে প্রকাশ করার মত বন্ধুত্ব থাকা)। ততদিনে স্বনামধন্য ফরাসি ব্যবসায়ী মসিয়েঁ পিয়ের গ্যত্রকে বিয়ে করেছেন ভার্জিনি এমেলি। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ফ্যাশন পত্রিকায় সাক্ষাৎকারও দিচ্ছেন ভার্জিনি পিয়ের গ্যত্র নামে। সবাই তাঁকে মাদাম গ্যত্র বলেই চিনত। তবে প্রেমিকের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না তাঁর! বহু পত্রিকা, সংবাদপত্র তাঁকে এবং তাঁর প্রেমিকদের নিয়ে লিখত। তৎকালীন প্যারিসের একজন নামজাদা শিল্পসংগ্রাহক এবং ডাক্তার ছিলেন ড. স্যামুয়েল জাঁ দে পোৎজি। ড. পোৎজির সঙ্গে মাদাম গ্যত্রর প্রেমকাহিনি ধীরে ধীরে শিল্পীমহলে চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। ১৮৮১ সালে এই ডাক্তারবাবুরই একটি পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন সার্জেন্ট। কে জানত এই পরিচয়ই তাঁর প্যারিস জীবনের কাল হয়ে উঠবে! 

পরবর্তীতে ভালো পরিচয়ের সুযোগে একদিন তাঁকে সাহস করে এই ব্যাপারে জিগ্যেস করলে ড. পোৎজি বেশ আনন্দিত হয়েই তাঁর প্রেমিকার সম্পর্কে ভাব ব্যক্ত করেন শিল্পীর কাছে এবং মাদাম গ্যত্রর কাছেও সার্জেন্টের প্রতিভার পরিচয় দেন(যদিও এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে যাঁরা সন্দিহান তাঁরা বলে থাকেন সার্জেন্ট নিজে গিয়েছিলেন এই কাজের জন্য)। কিন্তু পিয়ের গ্যত্র বা তাঁর স্ত্রী কেউনি চাননি যে প্যারিসে বসে ছবি আঁকার কাজটি হোক। ফলশ্রুতিতে শিল্পী আমন্ত্রণ পান মাদামের ব্রিটানি শ্যতুতে (ফরাসি ভাষায় শ্যতু শব্দের অর্থ বড়ো বাড়ি বা অট্টালিকা)। সেখানেই তিনি স্কেচ, জলরং এবং তৈলচিত্র মিলিয়ে তিরিশটি কাজ করেন। শর্ত ছিল শেষ ছবিতে নিখুঁতভাবে ধরতে হবে তাঁর মডেলের আভিজাত্য, চেহারা, ভঙ্গিমা ও পোশাক। শর্তে রাজি হয়ে প্রথমে স্কেচ দিয়ে শুরু করে আস্তে আস্তে পূর্ণাঙ্গ তৈলচিত্রে নিপুণভাবে তাঁকে তুলে ধরেন সার্জেন্ট। প্যারিস থেকে যাতায়াত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বন্ধু ভার্নন লি-কে চিঠিতে লেখেন - "Your letter has just reached me, still in this country house struggling with the unpaintable beauty and hopeless laziness of Mme. Gautreau.” 

 সর্বশেষ ছবিটিতে তাঁর অভিজাত মডেলের নাম গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেন শিল্পী এবং ১৮৮৪ সালে প্যারিস স্যালঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি হিসাবে সেটি বহুলভাবে চর্চ্চিত হয় বিচারকদের মধ্যে। তিনি ছবির নাম দিয়েছিলেন "Portrait of Mme." কিন্তু প্রদর্শনীতে অনেকেই চিনে ফেলেন মডেলকে এবং মাদাম গ্যত্রর পোজ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয় সারা শহর জুড়ে। তাঁর পরিধানে ছিল কালো ‘হার্ট-শেপ গাউন’। তাঁর ডান কাঁধ থেকে গাউনের স্ট্র্যাপ পড়ে যাবার তথাকথিত ‘সাহসী’ দৃশ্যকে ক্যানভাসে ধরেছিলেন শিল্পী, যেটি ফরাসি সমাজের নীতিবাদীরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। শিল্পবিশারদরা রীতিমতো নিন্দাসূচক বক্তব্য লিখতে থাকেন। দর্শকদের কেউ কেউ সার্জেন্টকে অভিশাপও দিয়েছিলেন ফরাসি রীতিনীতির বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য। যত না প্রশংসা পেয়েছিল তার অন্তত দশগুণ অভিসম্পাত কুড়িয়েছিল ছবিটি! অত্যন্ত নিন্দিত এই পোজের বিপক্ষে বলতে গিয়ে কেউ কেউ বলেন, যিনি ছবিটি এঁকেছেন তিনি আঁকতেই জানেন না কারণ তাঁর মধ্যে কোনো শিল্পীসত্তা নেই। 

বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মসিয়েঁ গ্যত্র-মাদাম গ্যত্র জুটিকে নিশানা করে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। ব্যাপারটি ক্রমে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে। নিউ ইয়র্ক টাইমস মন্তব্য করে যে ছবিটি একটি আদ্যোপান্ত ক্যারিকেচার! এতে গ্যত্রজুটির দাম্পত্য জীবনেও প্রভাব পড়ে। কাঁধ থেকে গাউনের স্ট্র্যাপ পড়ে যাবার দৃশ্য যে ফরাসি রক্ষণশীল সমাজে মোটেই ভালোভাবে গৃহীত হবে না সেই বিষয়ে কোনো ধারণাই ছিল না সার্জেন্টের। স্বল্প সময়ে ব্যাপারটি এমন তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয় যে মাদাম গ্যত্রর মা নিজে সার্জেন্টকে অনুরোধ করেন স্যালঁ থেকে ছবিটি সরিয়ে নিতে কারণ তিনি জানতেন এই কাণ্ডের ফলে তাঁর মেয়ে চিরকাল ফরাসি সমাজে নিন্দিত হতে থাকবে। কিন্তু শিল্পী কোনোভাবেই রাজি হননি কারণ তাঁকে বলা হয়েছিল যেমনভাবে আঁকতে তিনি ঠিক সেভাবেই ক্যানভাসে মডেলকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন একটুও নড়চড় না করে। ওদিকে মডেলও যে তাঁর এই হঠাৎ খ্যাতি পাওয়াকে একেবারে উপভোগ করছিলেন না, তেমনটাও নয়!  তারপর চাপে পড়ে অগত্যা ফের নাম পরিবর্তন করতে হল। এবার নাম হল "Portrait of Madame X"। পরবর্তীতে যাতে কেউ হঠাৎ মডেলের পরিচয় না বুঝতে পারেন তার জন্যই এমন নামকরণ। 

আরও পড়ুন
আত্মহত্যা করেননি ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ; হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে!

কিন্তু তাতেও হাল ছাড়লেন না ফরাসি নিন্দুকরা। পোশাকের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের বদলে নতুন নামকরণ করায় পুনরায় নিন্দার ঝড় বয়ে যায় প্যারিসে। শিল্পমহলে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়েন সার্জেন্ট এবং বাধ্য হয়ে গাউনের স্ট্র্যাপটিকে আবার আঁকেন; তবে এবার কাঁধের উপরে। এতসব সত্ত্বেও তাঁকে বাধ্য করা হয় প্যারিসের সমস্ত আর্ট স্যালঁ, গ্যালারি ইত্যাদি ত্যাগ করতে। এই সমস্ত ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে ফের একইভাবে কাঁধ থেকে গাউনের স্ট্র্যাপ ফেলে দিয়ে আবারও একই পোজে ১৮৯১ সালে ফরাসি চিত্রকর গুস্তাভ কুর্তোয়ার ছবির জন্য কাজ করেন মাদাম পিয়ের গ্যত্র। ঠিক যে পোজের জন্য একটি ছবিই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় অন্য এক প্রতিভাবান শিল্পীর। পরবর্তীকালে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাকাপাকিভাবে যাত্রা করেন জন সিঙ্গার সার্জেন্ট। ওখানেই কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে তাঁর প্রতিভার সর্বোত্তম স্তরে উঠতে পেরেছিলেন তিনি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা পোর্ট্রেট শিল্পী হিসেবে। কাজের সূত্রে প্রচুর ভ্রমণ করতেও শুরু করেন। ভেনিস শহরের অপার সৌন্দর্যকে জলরঙের মাধ্যমে তাঁর মত করে বোধহয় আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। আর পোট্রের্ট ছবিতে আজও তাঁর স্থান ধরাছোঁয়ার বাইরে! মাদাম গ্যত্রর কাঁধের উপর গাউনের স্ট্র্যাপ পুনরায় আঁকার পর তিরিশটি বছর সামলে রেখেছিলেন ছবিটিকে। হয়ত কোনো অব্যক্ত প্রেম ছিল ছবিটির প্রতি! তারপর নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্টে জায়গা পায় বহুল আলোচিত এই ছবি - "Portrait of Madame X" (শিল্পীর অনুরোধে মডেলের নাম প্রকাশ না করে X রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়)।

ছবিটি বিক্রির সময় সার্জেন্ট বলেন ‘আমার মনে হয় জীবনে আমি সবচেয়ে ভাল কাজটা করলাম!’

পরবর্তীতে ১৮৮৪ সালের প্যারিস স্যালঁ নিয়ে অনেক বইও প্রকাশ পায়। শিল্পের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া এই অনভিপ্রেত ঘটনা নিয়ে আজও আগ্রহ কম নয়! ফরাসি ভাষা, সাহিত্য এবং চিত্রকলা নিয়ে যাঁরা একটু আধটু ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাঁদের কাছে অতিপরিচিত প্যারিসের এই ফ্যাশন আইকন।

আরও পড়ুন
তিরিশ সেকেন্ডে ছাগলের ছবি এঁকে, ১ লক্ষ ডলার চেয়ে বসলেন পিকাসো

Powered by Froala Editor

More From Author See More