পাথুরে পার্বত্য শৃঙ্গ কেটে ধাপে ধাপে বানানো এক প্রাচীন নগরী। উচ্চতা প্রায় আট হাজার ফুট। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে গড়ে উঠেছিল এই প্রাচীন সভ্যতা। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে পেরুর ‘মাচু পিচু’ নিয়েই। ইনকাদের তৈরি এই পার্বত্য সভ্যতা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, দীর্ঘ একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ভুল নামেই পরিচিত হয়ে আসছে ‘মাচু পিচু’ (Machu Picchu)। সাম্প্রতিক গবেষণা জানাল এমনটাই।
হ্যাঁ, ‘মাচু পিচু’ নামে যে ইনকা সভ্যতাকে (Inca Civilization) আমরা জানি, তার আসল নাম ‘হুয়ানা পিচু’। সম্প্রতি ইনস্টিটিউট অফ আন্দিয়ান স্টাডিজের ‘নাওপা পাচা’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি। জড়িত ছিলেন গবেষক সিডার সিটির সাদার্ন উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়, শিকাগোর ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং পেরুর নৃবিজ্ঞানীরা। কিন্তু কীভাবে সামনে এল এই তথ্য?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে ‘মাচু পিচু’-র আবিষ্কারের লগ্নে। ১৪২০ সাল নাগাদ ইনকা সম্রাট পাচাচুটির আমলে তৈরি হয়েছিল মাচু পিচু সিটাডেল। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্প্যানিশরা ইনকাদের আক্রমণ ও পরাজিত করার পর পরিত্যক্ত হয় মাচু পিচু। তার অস্তিত্বও ধামা চাপা পড়ে যায় চিরদিনের মতো।
এর প্রায় চারশো বছর পর ১৯১১ সালে মার্কিন অভিযাত্রী হিরাম বিংহাম পেরু ভ্রমণের সময় নতুন করে পুনরাবিষ্কার করেন মাচু পিচুকে। বিংহামের ডায়েরি অনুযায়ী, তিনি এই জায়গার নামের সন্ধান পেয়েছিলেন এক স্থানীয় কৃষকের থেকে।
বছর কয়েক আগে ‘মাচু পিচু’-তে গবেষণা করার সময় মার্কিন বিজ্ঞানী ব্রায়ান বাউয়ারের নজরে আসে একটি প্রাচীন ইনকা পুঁথি। সেই পুঁথি পড়েই প্রথম তাঁর মনে সন্দেহ জাগে। পেরুর সংস্কৃতি মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ব্রায়ান। সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় পেরুর ঐতিহাসিক আমাদো গঞ্জালেজের সঙ্গে। তাঁরও প্রাথমিক মতামত ছিল একই। এর পরই শুরু হয় মাচু পিচু-র রহস্য অনুসন্ধান। সে-সময় পেরু স্প্যানিশ উপনিবেশ হওয়ায়, বিশেষভাবে প্রাচীন স্প্যানিশ নথি এবং দলিলগুলির ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন গবেষকরা। শেষ পর্যন্ত ১৫৮৮ সালের একটি প্রতিবেদনে অস্তিত্ব পাওয়া যায় ‘মাচু পিচু’-র আসল নামের। ইনকা রাজত্বকালে সময়ে মাচু পিচু পরিচিত ছিল ‘হুয়ানা পিচু’ নামে। স্থানীয় কেচোয়া ভাষায় ‘হুয়ানা’ কথাটির অর্থ ‘নতুন’ এবং ‘পিচু’-র অর্থ পর্বত’। প্রাচীন বসতি ছেড়ে নতুন করে এই সিটাডেল তৈরির কারণেই ইনকারা এমন নাম দিয়েছিলেন মাচু পিচুর। অন্যদিকে ‘মাচু পিচু’ কথাটির অর্থ ‘পুরনো পর্বত’। ১৯১১ সালে স্থানীয় কৃষকের মৌখিক ভাষায় তা একেবারেই ভুল নয় কোনোভাবেই। তবে ইতিহাসের নিরিখে ‘হুয়ানা পিচু’-ই আসল নাম মাচু পিচু-র। এমনটাই অভিমত গবেষকদের।
যদিও প্রাচীন এই সভ্যতার আসল নাম উদ্ঘাটিত হলেও, খাতায় কলমে ‘মাচু পিচু’ নামটিই অপরিবর্তিত থাকবে বলেই জানিয়েছে পেরুর সংস্কৃতি মন্ত্রক। কারণ, দীর্ঘ একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই নামেই পরিচিতি পেয়েছে মাচু পিচু। এই নামটির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্যও। তাই আবার নাম পরিবর্তনের পথে হাঁটছে না তারা। বদলে, স্থানীয় ইতিহাস বইতে এই মাচু পিচুর প্রাচীন নামের বিষয়টি সংযুক্ত করা হবে বলেই জানিয়েছে পেরু প্রশাসন…
Powered by Froala Editor