কবিসম্মেলনে ডাক পান না গীতিকাররা, আক্ষেপ করতেন গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার

শয্যা, লজ্জা, মজ্জা - প্রথম দুটো শব্দ দিয়ে কোনো কবিতা লেখা গেলে আশ্চর্য হবার কিছু থাকে না, মজ্জা শব্দটা তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে জুড়ে দেওয়াটাই চ্যালেঞ্জ। গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার করলেন তাই-ই।

‘জানি না তো এই ফাগুনে/ আমি জ্বলে মরি কিসের আগুনে/এ কোন খুশির বিজুরি/ শিহরে তনুর মজ্জায়/  আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি/ মোর নিশীথ বাসরশয্যায়/ মন বলে ভালবেসেছি/ আখি বলিতে পারেনি লজ্জায়...’  

রবীন্দ্রনাথের দাপট শেষ হবার ঠিক পর পর চারের দশক, পাঁচের দশক ছয়ের দশক সাত–আট অবধি মোটামুটি এই সময়ে সুবোধ পুরকায়স্থ হীরেন বসু, অজয় ভট্টাচার্য মোহিনী চৌধুরী থেকে শুরু করে পবিত্র মিত্র, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল দত্ত, শ্যামল গুপ্ত - এঁদের একটা দোষ ছিলই। সাধু-চলিতের যে মিশ্রণ ঘটিয়েছেন এঁরা কথায়— তাতে কোনো খাদ ছিল না। একই সঙ্গে এও সত্যি, এঁরা প্রেম-মিলন বিরহ-দেশপ্রেম-এ একটা নতুন ধারণা এনেছেন অনেক ক্ষেত্রেই। তা না হলে ‘প্রিয়ার প্রেমের লিপি লেখনি তরে হে বলাকা’—এ গানটা লেখা হত না। লেখা হত না ‘পৃথিবী আমারে চায় রেখো না বেঁধে আমায়’–এর মতো অসংখ্য বাংলা গান। 

এ-সময়ই গৌরিপ্রসন্ন এলেন তাঁর সময়ের ত্রুটি নিয়েই। এসেই কিন্তু মাত করলেন। গৌরিপ্রসন্ন সে সময়ের প্রায় সমস্ত শিল্পীর জন্যে গান লিখেছেন, এটা যেমন যত না চিত্তাকর্ষক তথ্য, তার থেকে বেশি চিত্তাকর্ষক তথ্য হল- সে সমস্ত শিল্পীর একাধিক জনপ্রিয় গানের রচয়িতা গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার। শিল্পীর নাম শুনলেই যে একটা দুটো গান প্রথমেই মনে আসে সেগুলোর সিংহভাগ ওঁর লেখা। এমনকি যে সুরকারের একটা গানের জন্যেই আমরা তাঁকে মনে রেখেছি সে গানও কিন্তু গৌরিপ্রসন্ন লিখেছিলেন! সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে মান্না দে যখন গান – ‘কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়/কতজন এলো গেলো কতজন আসবে কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়’... গৌরিপ্রসন্নের লিরিকে মনে পড়ে আমাদের পূর্ণেন্দু পত্রীর মুখ, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখ। মনে পড়ে, তারাপদ–শক্তি-সুনীল এক টেবিলে দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন!

 এই গৌরিপ্রসন্ন বাংলা আর ইংরেজি দুটো বিষয়ে এমএ পাশ করেন সে-সময়ে। সে-সময়ের আরেক জায়েন্ট অনুপম ঘটকের কাছে গানও শিখেছিলেন। কিন্তু হয়ে গেলেন গীতিকার! অবাক পৃথিবী সিনেমায় অমল মুখোপাধ্যায়ের সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটা গান গেয়েছিলেন গৌরিপ্রসন্নের কথায়—‘শুধু আঁধার ধূধূ আঁধার যতদূর পানে চাই’। সেখানে একটা অদ্ভুত ভালো সঞ্চারী ছিল – ‘ছায়া যদি বুকে বাঁধি, আলো হতে চায় আপনার, আলোরে বাসিলে ভালো ছায়া পিছু টানে বারবার!’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া অন্যতম সেরা সঞ্চারী। এই অমল মুখোপাধ্যায়ের সুরেই তো গৌরিপ্রসন্ন লেখেন, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু...’। অমল মুখোপাধ্যায় ‘হসপিটাল’ সিনেমায় সুযোগ পেয়ে গৌরিবাবুকে নাকি এমন গান লিখতে অনুরোধ করেন যাতে অমল মুখোপাধ্যায় চিরদিন থেকে যান বাংলা গানে! অমল মুখোপাধ্যায় তাঁর দাদা হেমন্তের মতো বিখ্যাত হননি ঠিকই, তবে এ-সুরটা এবং খুব অল্প হলেও কিছু ভালো সুর ছিল তাঁর।

গৌরিপ্রসন্ন স্কুল পেরোনোর আগেই কালিদাসের মেঘদূত ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। একজন কবির তো একটা নির্দিষ্ট সিগনেচার থাকে—সেটাই একজনের থেকে আরেকজনকে আলাদা করে! গৌরিপ্রসন্ন লিখেছিলেন ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে’। লিখতে গিয়ে সঞ্চারীতে লিখলেন, ‘আমার এ কূল ছাড়ি/তব বিস্মরণের খেয়া ভরা পালে অকূলে দিয়েছি পাড়ি’। ‘বিস্মরণের খেয়া ভরা পালে’ - এই কথাটা গৌরিপ্রসন্নের সিগনেচার! 

আরও পড়ুন
‘তোমার স্টাইলে গানটা রেকর্ড করলাম’ – চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে লিখে দিয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস

‘কাব্যের ভুল থাক তোমার গানের আর কারো গান আমি গাই না’ - এই হলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়! কিন্তু কখনওই পুলক বিস্মরণ গোছের ভারী শব্দ লিখবেন না। শোনা যায়, এঁদের দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না খুব একটা। মাঝখান থেকে নচিকেতা এর লাভটা ঘরে তুলতেন। দুজনকে মুখরার অংশটা দিয়ে বলতেন, যাঁর লেখা ভালো হবে, তাঁরটা নেবেন!

‘এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায়’ গানটা শুনতে শুনতে মনে হয়নি গানটা গৌরিবাবুর লেখা! কেন জানি না ব্যাখাতীত একটা অনুভূতি হয় রবীন্দ্রনাথের গান বলে! রবীন্দ্রনাথের কথা এদিক ওদিক করে গৌরিপ্রসন্নের গান আছে, ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’, যদি একবার মন দিয়ে শোনা যায় খেয়াল করা যাবে ঐ ‘মজ্জায়’ লুকিয়ে আছে, প্রেম এসেছিল, নিঃশব্দ চরণে।

‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’ - গানের যে গঠন, প্রেমের গানে, বা গানে এরকম প্রশ্ন করে করে বিড়ম্বনায় ফেলার চল ছিল না – ‘চাঁদের আলোয় রাত যায় যে ভরে/ তাহার মতো তুমি করো না কেন ওগো ধন্য মোরে!’ এক কথায় সাইলেন্স ইস দ্য বেস্ট রিপ্লাই!

আরও পড়ুন
‘শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি’, ভারত-চিন যুদ্ধে গানই হাতিয়ার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের

শুরু করেছিলেন শচীনদেব বর্মনের সঙ্গে। শচীনদেব বর্মনের একটা শেষের সঙ্গেও গৌরিপ্রসন্ন জুড়ে আছেন। হিন্দুস্থান রেকর্ডে শচীনদেবের শেষ গান- ‘বাসরের ফুল গেল যে শুকায়ে দীপ নিভে গেছে হায়’, গৌরিপ্রসন্নের লেখা। অসামান্য গান।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে শুনতে লিখে ফেললেন, ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি’। অংশুমান রায় নিজে সুর করে গেয়েছিলেন গানটা। 

‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’ - হেমন্তের গাওয়া অন্যতম সেরা গান! এ গানে লিখেছিলেন, ‘অশথের ছায়ে মাঠের প্রান্তে দূরে/রাখালি বাঁশি বেজে বেজে ওঠা সুরে/আমার এ গান খুঁজো তুমি/তারই মীড়ে’! বাঙালির কল্যাণে গুগলে মীড় কথাটা নীড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। খুঁজলেই পাওয়া যায়!

আরও পড়ুন
‘ফাইনালি যখন কাজটা আমিই করছি, আমিই আবহ সঙ্গীত রচনা করি’; সুরের জাদুর সেই শুরু

মান্না দে-র প্রথম দিকের বেসিক বাংলাগানের অনেকগুলোই গৌরিপ্রসন্নের লেখা। ‘নিশিপদ্ম’ সিনেমার একটা গান ছিল মান্না দে-র গলায়, আবার সেই গৌরিপ্রসন্ন–নচিকেতা ঘোষ জুটি, ‘যা খুশি ওরা বলে বলুক, ওদের কথায় কী আসে যায়/ওরাই রাতের ভ্রমর হয়ে নিশিপদ্মের মধু যে খায়’। আমাদের ছদ্ম মানবদরদের মুখে এ গানটা চপেটাঘাত ছাড়া আর কিছু কি?

পদ্মানদীর মাঝি-র গীতিনাট্য করেন দীনেন চৌধুরী, তার ইংরেজি চিত্রনাট্য একসময় লেখেন গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার। কবিসম্মেলনে কেন গীতিকারদের ডাকা হয় না, এ-নিয়ে একটা আক্ষেপও ছিল তাঁর।

পাঁচের দশকের প্রায় শেষে, ’৫৭ বা ’৫৮ সালে হেমন্ত একটা গান রেকর্ড করেছিলেন, ‘ধিন কেটে ধিন ধিন কেটে ধিন বাজে ঝড়ের ঢাক/তার সাথে ঐ কাঁসি বাজায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক’। এ-লেখায় সুর করতে নচিকেতা ঘোষের মতো লোকেরই প্রয়োজন। উল্লেখ করার উদ্দেশ্য একটাই, ব্যক্তিমানুষের প্রেমের গানের বাইরেও গৌরিপ্রসন্নের এটা একটা উল্লেখ করার মতো লেখা। বিদ্যুৎ আর মৌমাছি - দুজনের মধ্যে লড়াই, সেরা কে, এই নিয়ে। বিদ্যুৎ নিজেকে সেরা বলে প্রমাণ করতে মরিয়া। মৌমাছিকে দিয়ে শেষে গৌরিপ্রসন্ন বলালেন, ‘তোমার হাঁকে মাটি কাঁপে ফুল ও পাতা ঝরে/ আর আমার গানের মিষ্টি সুরে স্বপ্নে তারা ভরে/ তোমার আমার মধ্যিখানে এইটুকু যা ফাঁক!’

এই মানুষটা যদি কবিসম্মেলনে গীতিকারদের না ডাকার অভিমান নিয়ে বসে থাকেন, অসঙ্গত হয় কি? তিনি বলতেন কবিতায় সুর দিলেই গান হয় না। তাই যদি হত, রবীন্দ্রনাথকে অতগুলো কবিতা লেখার পর গান লিখতে হত না।

প্রেসিডেন্সির এই প্রাক্তনী ভালো রেজাল্ট করে অক্সফোর্ডে পড়তে যাবেন ভেবেছিলেন। থেকে গেলেন এখানে।  গেলে হয়তো আরেকজন ভালো অধ্যাপক পেতাম, হারাতাম নিশ্চিত নচিকেতা ঘোষের বন্ধুকে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বন্ধুকেও। বাঙালির অনেক ভাগ্য, একজন গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারকে পেয়েছিল তারা...

Powered by Froala Editor