উনিশ শতকের সেকালের অনেক বাবুগোত্রীয় লোকেদেরই অনেক রকমের শখ ছিল। এ-বিষয়ে সুনাম ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির। উপেন্দ্রমোহন ঠাকুর - ঠাকুরবাড়িরই আরেক শাখা - অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন। তাঁর শখ ছিল আবার ঋতুর সঙ্গে রং মিলিয়ে জামাকাপড় পরা। ছয় ঋতুতে ছয়রকম পোশাকে দেখা যেত তাঁকে। আশি বছর বয়সেও সেই শখের ব্যত্যয় ঘটেনি। তাঁর সেই সাজের আবার একটা ব্যাপার ছিল। যতই তিনি সাজুন না কেন, সেই সাজকে অনুমোদন করতেন তাঁর স্ত্রী। তিনি অনুমোদন না করলেই সেই সাজ আবার বদল হয়ে যেত। কানাইলাল ঠাকুরের আবার শখ ছিল পোশাকি মাছ খাওয়া। আর কেউ না জানলেও তাঁর পুরোনো রান্নার ঠাকুর জানত পোশাকি মাছের ব্যাপার। তাই বাবু খেতে বসলেই বড় বড় ‘লালকোর্তাপরা’ চিংড়িমাছ রেঁধে আনা হত। পোশাকি মাছ খেয়ে বাবু মহাখুশি।
জগমোহন গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের আবার ছিল রান্না আর খাওয়ার শখ। যেমন রাঁধতে জানতেন, তেমনই জানতেন খেতে। সেই খাওয়ার আবার এক অদ্ভুত পদ্ধতি ছিল। তাঁর অনেকগুলো বাটি ছিল, সকাল হলেই সেই বাটিগুলো বিভিন্ন লোকের বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন, এমনকি মেথরদের বাড়ি পর্যন্ত। যার বাড়িতে যা ভালো রান্না হয়েছে, তেমন একটা করে পদ বাটিতে আসত, বাবু তাই দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন করতেন।
ঘুড়ি ওড়াতে তো সবাই ভালবাসে। কিন্তু ঘুড়ির সঙ্গে টাকা বেঁধে ওড়াতে কেই বা ভালবাসে? কানাই মল্লিক মশাই ভালোবাসতেন। ঘুড়ির সঙ্গে পাঁচ-দশ টাকার নোট গেঁথে উড়িয়ে দিতেন। এমন বিপজ্জনক শখের ফল যা হবার তাই হয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, এই শখের জন্যই তাঁকে সর্বস্ব খোয়াতে হয়েছিল। তাতেই বা কি, শখ তো মিটেছিল!
এমন একটি যুগের হাওয়ায় এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছেলে হয়ে, দেবেন্দ্রনাথও যে বিলাসী জীবন যাপন করবেন সে তো সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু, ওই যে, দেবেন্দ্রনাথ ভোগ ও ত্যাগের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে জানতেন। না হলে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর বিপুল পিতৃঋণ কিছুতেই শোধ করতে পারতেন না। অবনীন্দ্রনাথের কথায় - “কর্তাদাদামশায় খুব হিসেবী লোক ছিলেন। মহর্ষিদেব হয়েছেন বলে বিষয়সম্পত্তি দেখবেন না তা তো নয়।” তবে এই হিসেবি মানুষটিই অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন ছোটোবেলা থেকেই। ছোটো থেকেই তাঁর পায়রা পোষার শখ। তিনি আর তাঁর সমবয়সী ভাগনে ঈশ্বর মুখোপাধ্যায়, স্কুল পালিয়ে টেরিটিবাজারে যেতেন পায়রা কিনতে। গানবাজনার শখও ছিল, টাকা গোনাগুনতির সময় দুতোড়া টাকা চলে যেত পুজোয় গানবাজনার জন্য। দেবেন্দ্রনাথের আবার কালোয়াতি গান, অর্থাৎ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক ছিল, নিজেই নাতিনাতনিদের বলেছিলেন সাহেবের কাছে পিয়ানো শেখার গল্প। এতোটাই শৌখিন ছিলেন যে, বড়ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথের পাইপ খাওয়া তাঁর পছন্দ হয়নি, ছেলের জন্য ‘ভাল তামাক’ আনানোর হুকুম দিয়েছিলেন। শৌখিনতার এমনই মহিমা যে বাবাও ছেলের জন্য ধূমপানের ভালো সামগ্রীর জোগান দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
ঠাকুরবাড়ির শখের থিয়েটার ও জোড়াসাঁকো নাট্যশালা
নোংরা একেবারেই বরদাস্ত হত না মহর্ষিদেবের। একটানা একই জামাকাপড় তাঁর রুচত না। কিছুদিন ব্যবহারের পর ওগুলো ফেলেই দেওয়া হত। তা অত দামি জামাকাপড় কি আর ফেলে দেওয়া যায়, চাকরবাকরেরাই ওগুলো পরে ফেলত। বড়োলোক মনিবের চাকর হওয়াও সুখকর, ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা সেটা উপলব্ধি করেছেন। বৃদ্ধ বয়সেও তোয়ালে দিয়ে গা মুছতেন না মহর্ষিদেব, গায়ে ব্যথা হবে যে! তার বদলে আসত দামি মসলিনের থান, সেখান থেকে টুকরো কেটে কেটে ব্যবহার করা হত। চাকররাই বা বসে থাকবে কেন, তারা অনেক সময়ই সেই মসলিন চুরি করে নিজেদের জামা বানিয়ে নিত। সেই মসলিন, যা নাকি বাড়ির ছেলেমেয়েরাও পরতে পায়নি কখনও। দীপেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই দুঃখ করে বলতেন, এরাই কর্তাদাদামশায়ের আসল নাতি! ধোপদুরস্ত মনিবের ধোপদুরস্ত ভৃত্যবৃন্দ। বয়সকালে একবার নাকি পারিবারিক ডাক্তার স্যান্ডার্স সাহেব চিকিৎসা করতে এসে হ্যান্ডশেক করার পর তিনি হাতের পাঁচটি আঙুল ফাঁক করে স্থিরভাবে হাতটিকে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, চাকরেরা হাত ধোয়ার জল দিলে হাত ধুয়ে তবে সেই হাত নাড়েন। নোংরা নিয়ে এমনই স্বভাব ছিল মহর্ষির। ঈশ্বর মুখোপাধ্যায় বলেছেন, একবার কল্পতরু হওয়ার শখ হল মহর্ষিদেবের। বাড়ির লোকজনের উপর হুকুম হল, ঘর থেকে যা যার ইচ্ছে নিয়ে চলে যাও। যে যা পারল নিয়ে চলে গেল, আর মহর্ষিদেব কল্পতরু হয়ে বেতের চেয়ারে বসে রইলেন।
আরও পড়ুন
ঘুমে আচ্ছন্ন ঠাকুরবাড়ি, গভীর রাতে স্ত্রী-র পাশে বন্ধুকে এনে বসালেন সত্যেন্দ্রনাথ
মহর্ষির নাতিনাতনিরা দেখেওছেন তার কর্তাদাদামশায়ের এই শৌখিনতার বহর। সাদা ফুল খুব প্রিয় ছিল, তাদের বলতেন গন্ধপুষ্প। তার বসার জায়গার পাশের টেবিলে পিরিচে করে সেই গন্ধপুষ্প থাকত। তার পাশে থাকত একটি পরিষ্কার রুমাল। যা কিছু খেতেন, একবার খেয়ে রুমালে মুখ মুছে সেটা মাটিতে ফেলে দিতেন। চাকরেরা কুড়িয়ে নিত, আবার আরেকটি সুন্দর রুমাল এসে যেত। এমনই ছিল শৌখিনতা।
আরও পড়ুন
অলংকার-সমেত প্রতিমার বিসর্জন, এমনই বৈভব ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুজোয়
কিন্তু আগেই বলা হয়েছে যে, ঐশ্বর্যের আস্ফালন আর শৌখিনতা এক জিনিস নয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যে বাবুগোত্রের মধ্যে থেকেও স্বতন্ত্র, সেটা কলকাতার বাবুসমাজের কাছে প্রমাণিত হয়ে গেছিল শোভাবাজার রাজবাড়ির এক জলসায়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, তখন সদ্য দেবেন্দ্রনাথের বিপুল পিতৃঋণ শেষ হয়েছে। বিষয়সম্পত্তি অনেকটাই হাতছাড়া। সেই অবস্থায় এল এই জলসার নিমন্ত্রণ। পিতৃঋণ শোধ করার খবর কলকাতার অনেক নামিদামি ব্যক্তিত্বও জানতেন। তাঁরা বলতে লাগলেন- দেখাই যাক প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র কী সাজে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসেন। এই খবর হাওয়ায় ভেসে মহর্ষির কানেও এল। তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষ। ডাক পড়ল করমচাঁদ জহুরির। হুকুম হল - আসল মুক্তোদানা দিয়ে একজোড়া মখমলের জুতো বানিয়ে দিতে হবে। ফরমাসমতো সেই জুতো এসে গেল। এবার নির্দিষ্ট দিনে দেবেন্দ্রনাথ দামি দামি জরি চুমকির কাপড় বাদ দিয়ে বাছলেন সাদা ধুতিপাঞ্জাবি, মাথায় সাদা মোড়াসা পাগড়ি। তখনকার দিনে সকলে নিমন্ত্রণে যেত কাটা কাপড় পরে, ধুতিপাঞ্জাবি কেউই পরত না। তাই দেবেন্দ্রনাথের পরিধান দেখে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। সেই জলসায় যেখানে সবাই দামি দামি রত্ন অলঙ্কার আর জরি-কিংখাবের পোশাকে সজ্জিত হয়ে আছেন, সেইখানে দেবেন্দ্রনাথের সাধাসিধে সাজ দেখে অনেকেই একটু বাঁকা হাসি হেসেছিলেন। কিন্তু যেই দেবেন্দ্রনাথ তাঁর মুক্তাখচিত পাদুকাযুগল একটু বের করে একটা কৌচে বসলেন, সকলের চক্ষুস্থির হয়ে গেল। এর পরেই দেবেন্দ্রনাথের বন্ধু শোভাবাজারের রাজার কথাটা প্রণিধানযোগ্য - “...একেই বলে বড়োলোক। আমরা যা গলায় মাথায় ঝুলিয়েছি ইনি তা পায়ে রেখেছেন।”
দেবেন্দ্রনাথের আবার রান্নাবান্নারও শখ ছিল। যে সে রান্না নয়, পায়সান্ন বা পায়েস রান্নায়। নিজেও পায়েস খেতে ভালোবাসতেন, রান্না করে খাওয়াতেও ভালবাসতেন। দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে যারা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাদের নিয়ে নিয়ম করে চাঁপদানির বাগানে যেতেন তিনি, সেখানে উপাসনার সঙ্গে পিকনিকও হত। একবার মহর্ষির শখ হল নিজের হাতে সবাইকে পায়েস রান্না করে খাওয়ানোর। মহর্ষির শখ বলে কথা, ঘড়া ঘড়া দুধ, সন্দেশ চলে এল। পায়েস রান্না করলেন, কিন্তু খাওয়ার শেষে একটু চেখেই সবাই হাত গুটিয়ে নিলেন। সত্যি কথা বলতেও পারেন না, আবার খেতেও পারেন না। শেষে দেবেন্দ্রনাথ রান্না কেমন হয়েছে জিজ্ঞাসা করায় আমতা আমতা করে বললেন, পায়েসে একটু ধোঁয়ার গন্ধ হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ সপ্রতিভভাবে বললেন, তিনি একটু ধোঁয়াটে গন্ধওয়ালা পায়েসই বেশি পছন্দ করেন। শখ করে পায়েস রান্না করতে গিয়ে যে সেটা একটু পুড়িয়ে ফেলেছিলেন, সে কথা সন্তর্পণে চেপে গেলেন মহর্ষিদেব। বাসনপত্রের ব্যাপারেও শৌখিন ছিলেন, নিজের হাতের মাপ অনুযায়ী বাটি ছাড়া দুধ খেতেন না। পাতলা কাঁচের গ্লাসও নাপসন্দ। শরবত আসত মোটা কাঁচের গ্লাসে।
শৌখিনতার চরম নমুনা শুনিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহর্ষিদেবের জন্য বরাদ্দ দুধ যাতে ন্যাচারালি মিষ্টি হয়, তাই তার গরুকে রোজ গুড় খাওয়ানো হত। দীপেন্দ্রনাথ ঠাকুর মজা করে বলতেন, সাক্ষাৎ নাতি হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা লুচির সঙ্গে গুড় পাননি, কিন্তু মহর্ষিদেবের গরু রোজ গুড় খায়। এর থেকে মনে হতেই পারে যে, রাজশেখর বসুর ‘রাজভোগ’ গল্পে ম্যানেজার রাইচরণ গোলাপি রঙের সুগন্ধি দুধ তৈরি করার জন্য গরুকে যে সাত দিন ধরে গোলাপফুল, গোলাপজল ও মিছরি খাওয়ানোর নিদান দিয়েছিল তা খুব একটা মিথ্যা নয়।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, উনিশ শতকের ব্রাহ্ম পরিমণ্ডলের এক গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্ব। তাঁর অতল গাম্ভীর্যের আড়ালে এক শৌখিন খেয়ালি মানুষের অস্তিত্ব, যা একই সঙ্গে অভিজাত ও অভিনব, তা পাঠকের সামনে মহর্ষির চরিত্রের এক অন্য দিককে উদ্ভাসিত করে।
Powered by Froala Editor