মাস্টারমশাই কিংবা ‘ইয়াক’-এর অপেক্ষা যেন ছুঁয়ে আসে রবীন্দ্রনাথকেও

পৃথিবীর সবথেকে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত একটি স্কুলকে নিয়ে গল্প। সিনেমার নাম - ‘লুনানা: আ ইয়াক ইন দ্য ক্লাসরুম’। আর এই সিনেমাটিই জিতে নিল কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বেস্ট ফিচার ফিল্মের পুরস্কার। পাশাপাশি, পরিচালক পাও চোং দোরজি পেলেন সেরা পরিচালকের পুরস্কারও। এই ভুটানি সিনেমাটি নিয়ে সিনেমাপ্রেমীদের মনে উৎসাহের কমতি ছিল না। বিশেষত গল্প ও দৃশ্যপট মন কেড়েছিল সকলেরই। কীভাবে এগোচ্ছে গল্পটি?

আরও পড়ুন
উড়তে চাওয়ার স্বপ্ন সত্যি, আরও সত্যি মাটির নির্মমতা - চেনাল 'উড়োজাহাজ'

সিনেমা শুরু হতে, স্কুলের পেম জং-এর হাসিমুখ প্রথমেই মন কেড়ে নিয়েছিল। সেই স্কুলে শিক্ষক হয়ে আসেন উগেন, সুদূর থিম্পু থেকে। অথচ, শহরের সমস্ত সুবিধে পেয়ে অভ্যস্ত সে। প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলের স্কুলে এসে বড়ই সমস্যায় পড়ে উগেন। ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু গ্রামের প্রবীণ মোড়ল তাকে দুটো দিন বিশ্রাম নিতে বলেন।

গল্পের মোড় সেখান থেকেই শুরু। সালদো নামের এক মিষ্টি মেয়ের গলায় ‘ইয়াক লেবি লাবা’ গানটি শুনে মোহিত উগেন গানটি শেখে। ইয়াক পালকের সঙ্গে ইয়াকদের এক অদ্ভুত সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক ভালবাসার। আমাদের যেমন নারকেল গাছের সবটুকু লাগে গৃহকর্মে, তেমনি পাহাড়ি এলাকায় ইয়াকের চামড়া, লোম, মাংস, দুধ, পায়ের খুর, শিং সবই কাজে লেগে যায় কোনো-না-কোনো ভাবে।

‘ইয়াক লেবি লাবা’ শুধু ইয়াকের গান নয়। ইয়াক এক পবিত্রতার প্রতীক। তাই গ্রামের এক ভদ্রলোক যখন উগেনকে বলেন ‘তুমিই আমাদের ইয়াক’, তখন আলাদা করে অবাক লাগে না।

https://www.youtube.com/watch?v=kvaBHAePl5k

কারো কারো চোখে আবার সরল প্রশ্ন। আচ্ছা স্যার(উগেন), আমাদের কেন ছেড়ে যাচ্ছেন? আমাদের কি আপনার ভাললাগছে না? যেন অবিকল পোস্টমাস্টারের কাছে রতনের প্রশ্ন। বাঙালি মন ছুঁয়ে আসে রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার-কে। সরল সাদাসিধে মন বুঝতে পারে না, কেন উগেন থাকতে পারবে না। ভুটান পৃথিবীর সবথেকে সুখী দেশ, অথচ সে-দেশ ছেড়ে উগেন কেন চলে যেতে চাইছে সাগরপারে? এ প্রশ্নের উত্তর নেই। উগেন যেন চলে না যায়, এই আর্তি নিয়ে ভিড় করে কান্নাভেজা চোখ। রতন ঠিক এভাবেই কি ঘুরেছিল পোস্ট অফিসের চারপাশে?

ইয়াক প্রতি সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। যদি না ফেরে, হয়তো পরের জন্মে ফিরবে। উগেন ফিরে আসে শহরে। অস্ট্রেলিয়ার কোনো এক বারে গান গাইতে গাইতে, সেই পাহাড়ি গান ‘ইয়াক লেবি লাবা’ গেয়ে ওঠে সে। তবে কি সেই গ্রামের মানুষগুলোর কাছে ফিরছে উগেন? শিশুগুলোর কাছে? ফিরবে কি সেই ইয়াক? নাকি রতনের কাছে পোস্টমাস্টার শুধুই এক আশার প্রদীপ!

পৃথিবীর সবথেকে দুর্গম এলাকায় শ্যুট করা হয়েছে সিনেমাটি। সেখানে বিদ্যুৎও নেই, শুধুই সোলার এনার্জিতে হয়েছে সম্পূর্ণ ছবির শ্যুটিং। এই শুটিংয়ের জন্য যেখানে পরিচালক ও তাঁর টিম ছিলেন, সেখানে মানুষ দু-মাসে একবার চান করে। শীতে জমে যেতে থাকে গা। লুনানা-র অধিবাসীরা জানেন না সিনেমা কাকে বলে, অভিনয় কী। আর তাই সরল মানুষগুলোর নিপাট কথাবার্তায় কোনো আড় ছিল না। সিনেমার সেই মেয়েটি এখনো হয়তো দেখছে তার মাতাল বাবাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে। উগেনের আসার অপেক্ষায় সারা স্কুল। ব্ল্যাকবোর্ডে ভুটানি অক্ষর মালা ঝোংকে। অবিকল ক, খ, গ এর মতো শুনতে...

কা খা গা আঁ
চা ছা ঝা না
টা ঠা দা মা

কানের পাশে এখনো বেজে চলেছে ইয়াকের গলার ঘণ্টা। পবিত্র পাহাড়ের কোনো প্রান্তে সেই গানের সুর মেঘের ভিতর মিলিয়ে যাচ্ছে...