সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানের ওপর দুপুরের রোদ পড়েছে। সেই কবে এই এলাকার ইতিহাস ‘থমকে গেছে’; তবুও এই সার বাঁধা ‘মৃত’দের মাঝেও কলকাতার পুরনো ইতিহাস ঘোরাফেরা করে। কতটুকুই বা জানতে পেরেছি আমরা; যতবার ঘুরি নতুন কিছু দৃশ্য সামনে উঠে আসে। নির্জন এই জায়গাটিতে কেবল নস্টালজিয়ার বাস নয়। সময় অসময় তরুণ-তরুণীরা চলে আসেন এখানে। শান্ত পরিবেশে ঘনিয়ে ওঠে প্রেম। আর সেসবের ফাঁকে ভেসে ওঠে অষ্টাদশ শতকের এক ইংরেজ তরুণীর মুখ। নিজের প্রেমিকের থেকে শত কিলোমিটার দূরে, কলকাতার এই পার্কস্ট্রিটে পাথর হয়ে আছে সে…
কোথায় সেই তরুণী? গোরস্থানে শুরু হল তল্লাশি। সৌধের আড়াল থেকে নিঃশ্বাস ভেসে আছে। চমকে উঠলেও, পরক্ষণেই সামলে নিই নিজেকে। আবারও শুরু হয় খোঁজ। হঠাৎই চোখে পড়ল লম্বা একটি গম্বুজের। এইরকম গম্বুজ তো কত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গোরস্থানে। বড়ো যত্নে তৈরি হয়েছিল এই বিশেষ সমাধিটি। চোখ পড়ল বেদির নিচেই একটি কালো ফলকের দিকে। তাতে লেখা আছে-
“Ah, what avails the sceptred race,
Ah, what the form divine!
What, every virtue, every grace!
Rose Aylmer, all were thine.
Rose Aylmer, whom these wakeful eyes
May weep but never see
A night of memories and sighs
I consecrate to thee”
এই তো সেই ইংরেজ তরুণী - রোজ এলমার। আর লেখাটি? একটু নিচে গেলেই দেখা যাবে কবির নাম, ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডর। ব্রিটিশদের সাহিত্যের ইতিহাসে হাঁটলে এঁর সঙ্গে পরিচয় হবেই। যিনি চার্লস ডিকেন্স, রবার্ট ব্রাউনির মতো সাহিত্যিকদের অনুপ্রাণিত করেছেন, তাঁকে কেমন করে অস্বীকার করা যায়! সেই ওয়াল্টার ল্যান্ডর, রোজ এলমার আর কলকাতা— যেন আশ্চর্য এক সুতোয় গাঁথা। যার ভরকেন্দ্রে রয়েছে একটাই শব্দ— প্রেম…
কাহিনির শুরুটা অবশ্য কলকাতায় নয়; ওয়েলসে। বছর বাইশের ওয়াল্টার ল্যান্ডর এসে পৌঁছেছেন সোয়ানসি। সবেমাত্র অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন, কবি হিসেবে ধীরে ধীরে পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন। ‘তরুণ কবি কখন তোমায় বলত লোকে’। একসময় আলাপ হল এলমার পরিবারের সঙ্গে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, ব্রিটিশ সমাজে এই এলমাররা ছিলেন যথেষ্ট প্রভাবশালী। এই পরিবারেরই ম্যাথিউ উইটওয়ার্থ এলমার ছিলেন একজন ব্রিটিশ মিলিটারি অফিসার। সেই জেরেই নিজের নাম হয়েছিল ‘লর্ড ‘বায়রন’ এলমার’। এমন পরিবারের সংস্পর্শে এলেন তরুণ কবি ল্যান্ডর।
আলাপও গাঢ় হল একটু একটু করে। এবং সেইসূত্রেই পরিচয় লর্ড এলমারের বোন— রোজ উইটওয়ার্থ এলমারের সঙ্গে। আমাদের গল্পের নায়িকা। রোজ তখন সতেরো বছরের ফুটফুটে তরুণী। আলাপপর্ব একটু এগোতেই একে অপরের দিকে আকৃষ্ট হলেন দুজনে। এবং সেখান থেকেই প্রেম। ওয়েলসের হাওয়া সাক্ষী সেই পরিবেশের। রোজ এবার ধরা দিল কবিতায়। খাতার পাতা ভরতে লাগল ল্যান্ডারের। একের পর এক লেখায় ফুটে উঠল সেই প্রেমের আখ্যান।
আরও পড়ুন
কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাণপুরুষ তিনি, বিস্মৃতির অতলে ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস
কিন্তু এই মেলামেশা এলমার পরিবার ভালোভাবে নিলেন না। ইতিমধ্যে রোজ এলমারের বাবা মারা গেলেন। এরপর তাঁর মা আরও একটি বিয়ে করলেন। রোজকে কি আর এখানে রাখা ঠিক হবে? উপরন্তু ওয়াল্টার ল্যান্ডর নামের ওই তরুণটির সঙ্গে যেন একটু বেশিই মিশছে ও। অতএব, পাঠিয়ে দাও দূরে। মায়ের বোন রয়েছেন কলকাতায়। তাঁর স্বামী, স্যার হেনরি রাসেল বিশাল ব্যক্তিত্ব। ওই জায়গাই রোজের জন্য ঠিক। অথচ মেয়েটির কথা কেউ শুনল না…
এই বিচ্ছেদ দুজনের কেউই মেনে নিতে পারেননি। ওয়াল্টার ল্যান্ডরের লেখায় ধরা দিতে লাগল এসব কথা। আর রোজ? তাঁর তো কবিতা নেই। ওয়াল্টারের মতো লিখতে পারেন না। মনের ভেতর গুম হয়ে রইল বাতাস। কলকাতায় এলেন বটে, কিন্তু শরীর একটু একটু করে ভেঙে পড়তে শুরু করল। সেই সময় ইউরোপ থেকে যারা আসতেন, তাঁদের অনেকেই রোগভোগের শিকার হতেন। ভারতের আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারতেন না। অনেকে দিরে যেতেন দেশে, অনেকে মানিয়ে নিতেন; আবার অনেকেই দেহ রাখতেন। সেই সারিতে পা রাখলেন রোজ এলমারও। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য। শুধু কি শরীরই দায়ী? মনের অসুখ কেউ খেয়াল করবে না?
কলকাতায় মারা গেলেন রোজ; আর সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে সেই খবর চলে গেল ওয়াল্টার ল্যান্ডরের কাছে। স্তব্ধ হয়ে রইলেন। লিখে ফেললেন কবিতা; আর সেটাই পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে রোজ এলমারের কবরের ফলকে খোদাই করা হল। শহর সাক্ষী থাকল এক অদ্ভুত প্রেমের গল্পের। রোজকে নিয়ে ল্যান্ডরের লেখা প্রতিটা কবিতাই আজ ইতিহাসে ঠাই পেয়েছে। কিন্তু এর ভেতরে যে অদ্ভুত বেদনা, সেটা কি বুঝতে পেরেছ শহর কলকাতা? …
আরও পড়ুন
কলকাতার আকাশে ভারতীয় বায়ুসেনার মহড়া, মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
তথ্যসূত্র –
‘শ্রীপান্থের কলকাতা’/ শ্রীপান্থ
Powered by Froala Editor