নিজাম পরিবারের কন্যার প্রেমে ইংরেজ সাহেব, বদলে নিলেন নাম–পোশাকও

আঠেরোশো শতকের শেষের দিক। ধীরে ধীরে ভারতের বুকে জালের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ব্রিটিশরা। বাংলার নবাবের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে প্রায় পুরোটাই, ওদিকে দিল্লির মুঘল রাজদরবারও ম্রিয়মান। বণিকের পোশাক ফেলে ক্রমশ শাসকের রূপ ধরছে ইংরেজরা। কিন্তু সেটাই কি একমাত্র চিত্র? বিদেশি আগমনের পর কত না ঘটনা ঘটেছে এই দেশে। সেখানে যেমন আছে যুদ্ধ, বিদ্বেষ; তেমনই রয়েছে প্রেম। তা না হলে খামোকা এক ব্রিটিশ সাহেবের জীবনে কেনই বা আসবেন এক ভারতীয় কিশোরী? এমনই সেই প্রেমের জোর, সাহেব নিজের পোশাক, এমনকি খ্রিস্টান পরিচয় বদলে হয়ে গেলেন ‘নবাব বাদশা’?

কাহিনিটা গোড়া থেকে শুরু করা যাক। পলাশির যুদ্ধ অতিক্রান্ত। বাংলার সূর্য অস্ত গেলেও, হায়দ্রাবাদের পতাকা তখনও উড়ছে। সিংহাসনে বসে আছেন নিজাম। কিন্তু যতই হোক, ব্রিটিশদের ঢেউ তো এড়ানো যাবে না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে সেখানে লোক রাখা হল। একটা সময় কোম্পানির রেসিডেন্ট হিসেবে সেখানে হাজির হলেন লেফটেনেন্ট কর্নেল জেমস কির্কপ্যাট্রিক। সাহেব হলেও, ইনি একটু অন্য রকমের ছিলেন। কির্কপ্যাট্রিকের জন্ম হয়েছিল মাদ্রাযেই। ছোটো থেকে ব্রিটিশ আদবকায়দার পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতিও তাঁর মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। ইংল্যান্ডে গিয়ে পড়াশোনা করলেও তামিল, উর্দুর ওপরও দখল ছিল ভালোই। এমনকি ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে প্রথম ভাষা হিসেবে তামিলকেই রেখেছিলেন… 

এমন একটি মানুষ যে ভারতের প্রেমে পড়বেন তাতে আশ্চর্য কোথায়! হায়দ্রাবাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে কাজ করলেও প্রায়শই নিজামের দরবারে যাতায়াত লেগে থাকত। কিন্তু বেশ কিছু ব্যাপার তাঁর নজর এড়িয়ে যেত। জাফরিকাটা জানলার পেছনে যে নারীরা তাঁকে দেখছে, সেটা তিনি আন্দাজ করতে পারেননি। কাজ এবং বিনোদন— এর বাইরে সেখানে আর তো কোনো সম্পর্ক নেই কির্কপ্যাট্রিকের। এমন ফর্সা, সুন্দর ইংরেজটির হাওয়া যে ভেতরমহলেও চলে যাবে, সেটা কে জানত! 

এরকমই একদিন নিজামের দরবার থেকে বাংলোয় ফিরেছেন। কিছুক্ষণ পর সেখানে হাজির হল একটি পালকি। কী ব্যাপার? জেমস কির্কপ্যাট্রিক বাইরে এসে দেখলেন, পালকির ভেতর থেকে নেমে এলেন এক বৃদ্ধা। তিনি এক বিশেষ খবর নিয়ে এসেছেন। নিজামের পরিবারের এক তরুণী নাকি জেমসকে মন দিয়ে ফেলেছেন। তাঁরই বার্তাবাহক হয়ে এসেছেন এই বৃদ্ধা। সাহেব যে এত সহজে গলবেন না সেটা অবশ্য তিনি বোঝেননি। পত্রপাট বিদায় নিয়ে চলে আসতে হল তাঁকে। বেশ কিছুদিন পর আবারও এক পালকি হাজির ব্রিটিশ বাংলোর সামনে। এ তো মহা জ্বালাতন! জেমস বাইরে এসে বৃদ্ধাকে ধমক দিতে যাবেন; এমন সময় তাঁর চোখ আটকে গেল পালকির দরজার দিকে। ঝালর সরিয়ে নেমে এলেন এক সুন্দরী তরুণী। নাম, খয়ের-উন-নিসা। তাহলে ইনিই হলেন সেই প্রণয়প্রার্থী! 

আরও পড়ুন
লালমুখো ব্রিটিশের আদলে তৈরি দেবসেনাপতি! কাটোয়ার ঐতিহাসিক ‘সাহেব কার্তিক’-এর গল্প

এবার আর ফেরালেন না কর্নেল জেমস কির্কপ্যাট্রিক। মন দিয়ে বসলেন এই তরুণীকে। নিজামের বংশের মেয়ে, রাজরক্ত বইছে শরীরে। ইংরেজ কোম্পানির উচ্চপদে আসীন সাহেব আসবেন ঘরের জামাই হিসেবে, এ তো আনন্দের কথা! কিন্তু একটা শর্ত— মুসলিম হতে হবে… 

খানিক তাজ্জব হওয়ারই কথা। হঠাৎ এভাবে সব বদলানো যায় নাকি! এরপর অবাক হওয়ার পালা ইংরেজদের। জেমস কির্কপ্যাট্রিক তখন খয়ের-উন-নিসার প্রেমে পাগল। বিয়ে করলে এঁকেই করবেন। অতএব, মুসলিম হওয়াই সই। লেফটেনেন্ট কর্নেল জেমস কির্কপ্যাট্রিকের নতুন নাম হল হাসমৎ জঙ্গ। শুধু নামই বদলাল না; আপাদমস্তক পোশাকও বদলে গেল সাহেবের। ইংরেজ পোশাক ছেড়ে পড়লেন মুঘলদের মতো পোশাক। শোনা যায়, চওড়া গোঁফও রেখেছিলেন জেমস, হুক্কা-পান-সুপুরি খাওয়া শুরু করলেন, বাইজির আসরে মেতে উঠলেন। এর আগে ভারত একজন ইংরেজ সাহেবের এমন দৃশ্য দেখেছে কি? পরেও কি খুব একটা নজরে এসেছে? 

আরও পড়ুন
বন্ধ হতে চলেছে ব্রিটিশ আমলের খালাসি ব্যবস্থা, অনিশ্চিত কর্মীদের ভবিষ্যত

এদিকে ইংরেজরা ভাবছেন, জেমস কির্কপ্যাট্রিক বিপদে পড়বেন। কারণ কোম্পানি বেশ কিছু বছর আগেই নিয়ম করেছিল, উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিরা যেন দেশীয় মেয়ের পাণিগ্রহণ না করেন। সেটা কোম্পানি এবং ইংরেজ রাজপুরুষের পক্ষে অপমানজনক হবে। সেসব নিয়মকে থোড়াই কেয়ার করে এমন একটা কাজ করলেন জেমস কির্কপ্যাট্রিক। প্রেমে অন্ধ একেই বলে! এবার চাকরিটা থাকবে তো? মসনদে তখন গভর্নর-জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি। তিনি দেখলেন, যতই নবাব হয়ে যান, যতই দেশীয় মেয়ের সঙ্গে প্রণয় হোক; জেমস কিন্তু কাজের কাজটি করে যাচ্ছেন। কোম্পানির হয়ে তাঁর রেকর্ড একদমই মন্দ নয়। বরং ‘নবাবি’ চালচলন হওয়ার পরও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে কাজ করছেন। অতএব, এঁকে হাতছাড়া করা যাবে না। মনঃক্ষুণ্ণ হলেও, মকুব করা হল যাবতীয় ‘অপরাধ’… 

খয়ের-উন-নিসার গর্ভে দুই সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু জেমসের আয়ু বোধহয় বেশিদিন লেখা ছিল না। কলকাতায় এসেছিলেন ছুটি কাটাতে। তারপরই হঠাৎ করে মারা যান জেমস কির্কপ্যাট্রিক। তখনকার দিনে ভারতের আবহাওয়া অনেক বিদেশিদেরই সহ্য হত না। আজও কলকাতার সেন্ট জন’স চার্চের গোরস্থানে গেলে জেমস ‘হাসমৎ জঙ্গ’ বাহাদুরের সমাধি দেখা যাবে। হায়দ্রাবাদে থাকাকালীন নিজামের রাজদরবারে তাঁর ছবিও আঁকা হয়েছিল। ইংরেজ পোশাক নয়; নবাবি পোশাকে সেখানে সজ্জিত জেমস। এছাড়াও হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত কোটি রেসিডেন্সি তৈরি করেছিলেন তিনি। সেই সব চিহ্ন আজও রয়ে গেছে এই ভারতের বুকে। আর খয়ের-উন-নিসা? তাঁর কী হল, সে সম্পর্কে সেরকম জানা যায় না। তবে তাঁদের কন্যা, ক্যাথরিন ‘কিটি’ কির্কপ্যাট্রিক সেই অসম প্রেমের কাহিনির অংশ হয়ে থেকে গিয়েছিলেন। 

আরও পড়ুন
দু’শো বছর আগের অজ্ঞাতপরিচয় বাঙালির আঁকা ছবি, জায়গা পাচ্ছে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে

তথ্যসূত্র-
১) ‘শ্রীপান্থের কলকাতা’/ শ্রীপান্থ
২) ‘A love story that broke the conventional boundaries of Empire’, William Dalrymple, BBC 

Powered by Froala Editor

More From Author See More