নরওয়ের ভাইকিং উপজাতির মানুষদের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে তারা দল বেঁধে বসবাস করত বরফে ঢাকা পাহাড়ি উপত্যকায়। নিছক গল্পকথা নয় সেসব। ইউরোপের অনেক দেশের সঙ্গেই ভাইকিংদের বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে প্রবল ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করতে না পেরে অনেকেই ছড়িয়ে পড়েন ইউরোপের নানা দেশে। যাঁরা থেকে গিয়েছিলেন, ত্রয়োদশ শতকের প্লেগ মহামারীর কবলে পড়ে প্রাণ হারান প্রত্যেকেই। তখনই এই প্রাচীন জনজাতিটির ইতিহাস প্রায় মুছে যায়। কিছু প্রচলিত কাহিনি ছাড়া তাদের সম্বন্ধে জানা যায়নি কিছুই। তবে এর মধ্যেই হঠাৎ কিছু পুরনো সরঞ্জাম খুঁজে পেলেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। আর সেখান থেকেই উঠে আসতে পারে ভাইকিংদের অনেক অজানা তথ্যই।
গবেষণা শুরু হয় ২০১১ সালে। দক্ষিণ নরওয়ের জোতানহেইমেন পাহাড়ের একটি হিমবাহের নিচে পাওয়া গেল একটি উলের তৈরি টিউনিক ধরনের পোশাক। পর্বতারোহীরা এই পোশাক খুঁজে পেয়েই তুলে দিলেন প্রত্নতাত্ত্বিকদের হাতে। আর এরপর সেই হিমবাহের নিচ থেকেই পাওয়া গেল অন্তত ১০০টি এমন উপাদান, যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, একসময় এই অঞ্চলে নিয়মিত পায়ের ছাপ রেখেছে ভাইকিংরা। সেইসব সরঞ্জামের মধ্যে আছে স্লেজ গাড়ি, ঘোড়ার ক্ষুর, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠার লাঠি, পায়ের জুতো, অস্ত্রশস্ত্র। চার বছর ধরে এইসব সরঞ্জাম সংগ্রহ করার পর গবেষণা শুরু হল ল্যাবরেটরিতে। প্রত্নতাত্ত্বিক লার্স পিলোঁর নেতৃত্বাধীন দল কার্বন ডেটিং করে দেখলেন, একেকটি সরঞ্জামের সময়কাল মোটামুটি ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। প্রথমদিকের সরঞ্জামের সঙ্গে যাযাবর উপজাতিদের যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকলেও, ৩০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রীতিমতো বড়ো একটি সভ্যতার জন্ম হয়েছিল এখানে। আর সেই সভ্যতা যে পরবর্তী হাজার বছর টিকে ছিল, সেই প্রমাণ তো আগেই পাওয়া গিয়েছে।
তবে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এই পথে কেন নিয়মিত যাত্রা করতেন ভাইকিংরা, সে প্রশ্নের যথাযথ উত্তর এখনও ঐতিহাসিকদের কাছে নেই। অনেকে মনে করছেন, এই পথ দিয়ে তাঁরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা করতেন। তবে কাছাকাছি সমুদ্রপথে যাওয়ার জন্য এই রাস্তা ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে না। আবার নানা ধরনের ফসল নিয়ে যে সদলবলে এই রাস্তা পেরোতেন ভাইকিংরা, সে প্রমাণ তো পেয়েছেন তাঁরা। অতএব অনেকের অনুমান, প্রবল ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে শীতকালে দক্ষিণ দিকে চলে আসতেন তাঁরা। আবার গরম পড়লে উত্তরে রওনা হতেন। আর এই বাসস্থান পরিবর্তনের জন্যই এই রাস্তা ব্যবহার করা হত।
পাহাড়কে আপাত দৃষ্টিতে যোগাযোগের পথে বাধা মনে হলেও, অনেক সময় সঠিক রাস্তা চেনার জন্য পাহাড়কেই বেছে নিতেন সেকালের মানুষ। এমন প্রমাণ অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। কিন্তু সেই পাহাড়ি হিমবাহের নিচে হাজার বছরের পুরনো সমস্ত উপাদান সযত্নে সংরক্ষিত অবস্থায় থাকবে, এমন আশা করেননি কেউই। তবে ইতিহাস কতভাবে তার চিহ্ন রেখে যায়, সেকথা বলা কঠিন। আরও অনেক হিমবাহের নিচে হয়তো প্রয়োজনীয় অনেক তথ্যই পাওয়া যেত। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যে দূষণের প্রভাবে নরওয়ের অনেক হিমবাহ সমুদ্রে মিশে গিয়েছে। ফলে সেসব উপাদান আর পাওয়া যাবে না কোনোদিন। লার্স পিলোঁর মনে এই নিয়ে একটু হতাশা থেকেই গিয়েছে। তবে যা পাওয়া গেল, তাই বা কম কী? ভাইকিংদের প্রাচীন উপকথা ক্রমশ ইতিহাসে পরিণত হতে আর বেশি দেরি নেই।