কোথায় হারিয়ে গেল রামপুর নবাবদের কোটি কোটি টাকার গুপ্তধন? আজও জাল কাটেনি রহস্যের

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগের কথা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে উঠে এসেছিল উত্তর প্রদেশের রামপুরের খসবাগ প্রাসাদ। কেন না সেখানেই রয়েছে রামপুরের নবাবদের ‘শাহী খাজানা’। তবে সেই সিন্দুকের কাছে হার মানতে বাধ্য আজকের প্রযুক্তিও। বিভিন্ন উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বচসা চলছিলই দীর্ঘদিন ধরে। ২০১৯ সালে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। আর তার পর থেকেই শুরু হয়েছিল সিন্দুক ভাঙার প্রচেষ্টা। প্রায় ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চাবির কোনো সন্ধান না থাকায় পড়েছিল এই একটা মাত্র পথ। তবে বিশেষজ্ঞ ওয়েল্ডাররাও বারংবার ব্যর্থ হয়েছেন ৮ ফুট লম্বা ৬ টন ওজনের এই লোহার দরজা ভাঙতে। শেষ পর্যন্ত গত বছর মার্চ মাসে সক্ষম হন তাঁরা।

সমস্ত সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি ছিল সেইদিকেই। হাজার হাজার কোটি টাকার গুপ্তধন তো মুখের কথা নয়! তবে কে জানত অপেক্ষা করে আছে অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স? লোহার দরজা ভাঙার পর আরও পাঁচ দফার বাধা পেরিয়ে যখন ‘খাজানা’-র ভাণ্ডারে পৌঁছনো গেল, তখন আবিষ্কৃত হল তা পুরোপুরি ফাঁকা! সেখানে শুধু জমে রয়েছে ধুলোর পরত আর অন্ধকার।

তবে কি ‘শাহী খাজানা’-র এই গল্প এতদিন পুরোটাই ছিল ভাঁওতা, মনগড়া? আর যদি এই ধনসম্পদের অস্তিত্ব কোনোদিন সত্যিই থেকে থাকে, তবে তা গেল কোথায়? এই উত্তরে পৌঁছনোর আগে রামপুরের ইতিহাস একঝলক না দেখে নিলে ধাঁধাঁটার শেষ অবধি পৌঁছনো বেশ কঠিন। আর সেইসঙ্গে আসবে কিছু বিরল নথি, দস্তাবেজের কথাও। যা এই বৃহত্তর পাজেলের ছোটো ছোটো টুকরো হিসাবেই ধরে নেওয়া যায়।

দিল্লি থেকে ২৪২ কিলোমিটার পূর্বে রোহিলখণ্ড অঞ্চলে অবস্থিত রামপুর। একসময় শুধুই জনশূন্য বন আর তৃণভূমি ছিল রোহিলখণ্ড। পরে আফগানিস্তানের ‘রোহিলা’ জনগোষ্ঠী এসে বসতি স্থাপন করে এই অঞ্চলে। মিশে যায় ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে। সেটা ছিল ষোড়শ শতকের শেষের দিক। মোঘল শক্তির পতনের পর উত্তরপ্রদেশের এই অঞ্চলে একছত্র ক্ষমতা বিস্তার করে আফগান জনগোষ্ঠীটি। পরবর্তীতে আফগান শাসক আহমদ শাহের ভারত আক্রমণের পিছনেও হাত ছিল তাঁদের।

আরও পড়ুন
পাকিস্তানের পতাকা উড়ল হাজারদুয়ারিতে, অসহায় সাক্ষী মুর্শিদাবাদের ‘নখদন্তহীন’ নবাব

রামপুর রাজপ্রাসাদ

 

 

আরও পড়ুন
কলকাতায় নির্বাসিত ওয়াজেদ আলি শাহ, নবাবি শখেই তিলোত্তমা পেল ঘুড়ির উত্তেজনা

১৭৭৩ সাল নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং আউধের নবাবরা রোহিলখণ্ড আক্রমণ করে সংযুক্ত করেন আউধের মূল রাজত্বের সঙ্গে। পরিবর্তে আফগান ওয়ারলর্ড ফয়জুল্লাহ খানকে দেওয়া হয় রামপুরের ছোট্ট জমিটুকু। সেইসঙ্গে ব্রিটিশরা সাক্ষর করে সুরক্ষা প্রদানের চুক্তি। সেইসময় থেকেই প্রায় দুই শতক অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতা পর্যন্ত রামপুরে রাজত্ব করেছেন আফগান শাসকরা। 

যাই হোক, চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পর যুদ্ধবিরতি হল বটে, তবে ফয়জুল্লাহ খান মুঘল অভিজাত পরিবারগুলির থেকে বিরল ও মূল্যবান পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করা অব্যাহত রাখলেন। গড়ে তুললেন একটি গ্রন্থাগারও। আজও ভারতের অন্যতম প্রাচীন পুঁথিদের গ্রন্থাগার হিসাবে বিবেচিত হয় রামপুরের এই লাইব্রেরি। শুধু লাইব্রেরিই নয় রামপুর সেসময় হয়ে উঠেছিল উত্তর ভারতের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রখ্যাত গজল গায়িকা বেগম আখতার এবং জদ্দনবাই ছিলেন রামপুরের সভাগায়িকা।

আরও পড়ুন
নবাবি ঐতিহ্য এখন অতীত, কলকাতার বুকে মৃত্যুর দিন গুনছে ‘মুর্শিদাবাদ হাউজ’

সংস্কৃতির পাশাপাশি রামপুরে গড়ে উঠেছিল চিনি, ডিস্টিলারি এবং টেক্সটাইলের মতো অসংখ্য শিল্প। যার ওপরে ভর করে রামপুরের আয় প্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল তিনগুণ। একটা হিসাব দিলে স্পষ্ট হয়ে যাবে ব্যাপারটা। তৎকালীন সময়ে ৩ হাজার বর্গ মাইলের কোলহাপুরে বার্ষিক আয় ছিল ১২.৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে মাত্র ৮০ বর্গমাইলের রামপুরের বার্ষিক আয় ছিল ভারতীয় মুদ্রায় ১১ কোটি। রামপুর নবাব হামিদ আলি খানের সভায় সোনার সিংহাসন এবং হুক্কার ছবি আজও প্রমাণ দেয় সেই স্বর্ণযুগের।

রামপুর নবাব আলি খান পুনর্নিমাণ করেন খসবাগ প্রাসাদ। যা ছিল ভারতের সর্বপ্রথম শীততাপ নিয়ন্ত্রিত প্রাসাদ। দুটি উত্তপ্ত সুইমিং পুল, বেসরকারি নাইটক্লাব, সিনেমাহল তো ছিলই, সেইসঙ্গে প্রাসাদের একেবারে কেন্দ্রে ছিল শাহী খাজানার সেই ট্রেজার ভল্ট। যা যুক্ত ছিল নবাবের শয়নকক্ষের সঙ্গে। কাজেই ধনসম্পদের কথা যে ভাঁওতা, তা একেবারেই নয়। 

কিন্তু কী ছিল সেখানে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য এবার ফিরতে হবে ভারতের ভাইসরে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের দস্তাবেজে। কারণ নবাব এবং তাঁর ভাইরা ছাড়া একমাত্র ব্যক্তি হিসাবে ট্রেজার ভল্ট পরিদর্শনের অনুমতি মিলেছিল তাঁরই। ১৯৪২ সালে লিখিত মাউন্টব্যাটেনের ডায়েরি থেকে জানা যায় প্রচুর অমূল্য রুবি, বিরল পান্না আর হিরের গহনা মজুত ছিল সেই ভল্টে। এখানেই শেষ নয়। নবাবের নেকলেসে অবস্থানরত চারটি দুর্মূল্য গোলকোন্ডা হিরের কথাও লিখেছেন মাউন্টব্যাটেন। দ্য এম্প্রেস অফ ইন্ডিয়া, ক্লোনডাইক এবং ‘দ্য টুইন’— এই চারটি হিরেকেই কোহিনুর এবং হোপ ডায়মন্ডের পরে বিশ্বের তৃতীয় মূল্যবান হিরে হিসাবে বিবেচনা করা হয়। 

রামপুর নবাবদের ব্যবহৃত সোনার পালঙ্ক

 

বিষয় হল মাউন্টব্যাটেনের এই ডায়েরি ছাড়া এই হিরের বিবরণ ভারতের আর কোনো পুঁথিতেই পাওয়া যায় না। এছাড়াও মুক্তোর অসংখ্য করোনেট, টায়রা, ব্রেসলেট, আংটি, কানের দুল, ইপিলেট ছিল সেখানে। ছিল নজরকাড়া তিনটি মুক্তোর হার, যার প্রতিটির দাম ছিল তৎকালীন সময়ে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। প্রতিটিই অলঙ্কৃত ছিল বুড়ো আঙুলের নখের থেকেও বড়ো মুক্তোয়। 

সেই ভল্ট যে কতটা দুর্ভেদ্য তাও বর্ণনা রয়েছে মাউন্টব্যাটেনের খাতায়। নবাবের ঘর থেকে প্রায় ২০০ মিটারের একটি করিডোর পেরিয়ে ছিল ইস্পাতের শাটার গেট। তা খোলার পর পিছনে বেশ শক্ত আরও একটি ধাতব দরজা চোখে পড়বে। যা একসঙ্গে দুটি চাবির মাধ্যমেই খোলা সম্ভব। তারপর ভল্টের মূল দরজা। সেই দরজা খুলে প্রবেশ করলেও ছোঁয়া যাবে না গুপ্তধন। সেখানে প্রতিটি শ্যাফে সিন্দুকেও ছিল দ্বিস্তর সুরক্ষার বন্দোবস্ত। আর দেওয়াল, মেঝে, ছাদ— সবটাই নির্মিত ৩-৪ ফুট পুরু পাথরে। সেইসঙ্গে বাইরের প্রহরা তো আছেই। সেকথা বাদই থাকল নয়। এই ভল্ট তৎকালীন সময়ে তো বটেই, আজও কোনো ডাকাতের পক্ষেই ভেদ করে প্রবেশ এক কথায় অসম্ভব।

২০২০ সালে সেই ভল্ট ভাঙার পর হুবহু মিলে গিয়েছিল মাউন্টব্যাটেনের এই বিবরণ। এতএব এই গুপ্তধন যে মনগড়া নয়, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু গেল কোথায় এসব রত্ন, মণিমাণিক্য? মৃত্যুর আগে নবাব আলি খান তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাত পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দেন। তবে মৃত্যুর পরে কখনোই আর হয়ে ওঠেনি শান্তিপূর্ণ বণ্টন। সত্তর দশকের শেষের দিক থেকেই পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে তিক্ততা দেখা দেয় ভাইদের মধ্যে। সেসময় প্রসঙ্গও উঠেছিল রামপুরের রত্নগুলি নাকি পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। উল্লেখ্য সেই সময় থেকেই ‘নিখোঁজ’ রামপুর প্রাসাদের এই ভল্টের চাবিও।

সত্যিই কি তবে আলি খানের কোনো উত্তরাধিকারীই সেসব বিদেশে পাচার করে দিয়েছিলেন চড়া দামে? নাকি মৃত্যুর আগে আলি খান নিজেই সেসব সম্পদ সরিয়ে রেখেছিলেন অন্য কোনো গোপন ভল্টে? তার সন্ধান হয়তো আজও জানা নেই কারোর, কিংবা নথিভুক্ত নেই কোথাওই। আলি খানের মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে প্রায় ৫০ বছর। এখনো জট কাটেনি এই রহস্যের। আর এই দুই সম্ভাবনার মধ্যেই ঝুলে রয়েছে সেসব রত্নদের অস্তিত্ব। যে পাজেল সমাধান করতে এখনও হয়তো কয়েক দশক সময় লেগে যাবে অনুসন্ধানকারীদের…

তথ্যসূত্র :
১. Rampur’s Treasure Trove, Akshay Chavan, Livehistoryindia
২. Nawabs Of Rampur, Books LLC
৩. উইকিপিডিয়া

Powered by Froala Editor

More From Author See More