পুলিশে পুলিশে ছেয়ে গেছে গোটা এলাকা। চলছে চিরুনি তল্লাশি। এই অঞ্চলেই নাকি লুকিয়ে রয়েছে কোনো এক দাপুটে বিপ্লবী। অবশ্য ব্রিটিশ সরকারের ভাষায় তিনি দেশদ্রোহী। শেষ পর্যন্ত সন্ধান মিলল তাঁর। তিনি আর কেই নন, এক ছাপোষা প্রবীণ মাস্টারমশাই। সংসার নেই যাঁর, পরিবার বলতে ছাত্র-ছাত্রীরাই। তবে তাঁর বেহালার বাক্সের মধ্যে লুকনো বোমা এবং গীতার সংস্করণই, তাঁর মাস্টারমশাই-এর চরিত্রের পিছনে লুকিয়ে থাকা বিপ্লবী সত্তার প্রমাণ। ফলে, গ্রেপ্তার হতে হল তাঁকে। হাত-পায়ে বাঁধা হল দড়ি। এবার তাঁর গন্তব্য হয় ফাঁসির মঞ্চ, না হয় কারাগার। তবে মৃত্যুদণ্ড কিংবা আজীবন কারাদণ্ড নিয়ে এতটুকুও ভাবিত নন তিনি, বরং গৃহকর্তাকে বিড়ম্বনায় ফেলার অপরাধ বোধের ছাপ স্পষ্ট তাঁর চোখে মুখে…
হ্যাঁ, কথা হচ্ছে তরুণ মজুমদারের (Tarun Majumder) ‘বালিকা বধূ’ (Balika Badhu) সিনেমাটি নিয়েই। সিনেমার শেষ লগ্নের এই দৃশ্যে চোখ ভিজে যাননি— এমন দর্শক খুঁজে পাওয়াই বিরল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হল তাঁর? ফাঁসি নাকি আজীবন কারাবাস? ‘বালিকা বধূ’ দেখার পর এই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে বার বার। তবে শুধু সিনেমার চরিত্রটিই নয়, চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছিলেন ‘বালিকা বধূ’-র মাস্টারমশাই-এর চরিত্রে অভিনয় করা মানুষটিও। বড়ো পর্দায় শেষ তাঁকে দেখা গিয়েছিল এই চলচ্চিত্রেই। তারপর?
গল্পটা শুরু করা যাক আরও একটু আগে থেকে। তখনও ‘বালিকা বধূ’-র প্লট, চিত্রনাট্য, সংলাপ নিয়ে মাথার মধ্যে কাটা-ছেঁড়া করে চলেছেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। চরিত্রের জন্য যুতসই অভিনেতার সন্ধানও চলছে সমান্তরালভাবে। অনুপকুমার, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, অনুভা গুপ্তদের তিনি মনে মনে বসিয়ে ফেলেছেন পছন্দমতো চরিত্রের আসনে। তাঁকে শুধু ভাবাচ্ছে এক প্রবীণ মাস্টারমশাই-এর চরিত্র। সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক গৃহশিক্ষক। সাত্ত্বিক, নিরহংকারী, নিঃসম্বল মাটির গন্ধ ঘেঁষা একজন মানুষ। নিকটজন বলতে কেবলমাত্র ছাত্রছাত্রী আর বেহালার সুর। অথচ, তাঁর ভেতরেই ধিকি-ধিকি জ্বলছে বিপ্লবের আগুন।
অভিনয়ের মাধ্যমে এই চরিত্রকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন— এমন শিল্পীর অভাব নেই বাংলার সিনেমাজগতে। কিন্তু পরিচিত, জনপ্রিয় অভিনেতাদের এই চরিত্রে অভিনয় করতে দেখলে আদৌ কি আন্দোলিত হবে দর্শকদের মন? শিল্পীর ইমেজের কাছে কোথাও গিয়ে যেন ঢাকা পড়ে যাবে মাস্টারমশাই-এর নীরব চরিত্রটা। এই বিষয়টাই ভাবিয়ে তুলেছিল তরুণ মজুমদারকে। তবে অভিনেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া যতটা কঠিন হবে ভেবেছিলেন তিনি, ততটাও সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি তাঁকে। প্রায় অলৌকিকভাবেই সমাধান এসে হাজির হয়েছিল তাঁর সামনে।
আরও পড়ুন
মৃতপ্রায় সময়ের রূপকথা লিখেছিলেন তরুণ মজুমদার
টলিপাড়ায় সেদিনও চিত্রনাট্য নিয়ে কাটাকুটি করতে ব্যস্ত ছিলেন তরুণ মজুমদার। সেইসময়ই দৃশ্যটা নজর টানে তাঁর। লনে দাঁড়িয়ে আপনমনে সিঙাড়া খাচ্ছেন প্রবীণ এক ব্যক্তি। মুখময় সাদা দাড়ি, ঘাড় অবধি লম্বা চুল। শান্ত-স্নিগ্ধ দৃষ্টি দু-চোখে। ইনিই যদি মাস্টারমশাই হন? সেদিন মনে মনে মাস্টারমশাই-এর চরিত্রে তাঁকেই বসিয়ে ফেলেছিলেন তরুণ। বাকিটা ইতিহাস।
আরও পড়ুন
ব্যতিক্রমী বিজ্ঞাপনেই কাননদেবীর নজর কেড়েছিলেন তরুণ, খুলেছিল ভাগ্য
১৯৬৭ সালে মুক্তি পেল ‘বালিকা বধূ’। বলতে গেলে গোটা বাংলায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল তরুণ মজুমদারের এই সিনেমা। রীতিমতো চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছিল মাস্টারমশাই চরিত্রটিকে নিয়ে। কোথাও গিয়ে যেন মূল চরিত্রদের অভিনয়কেও ছাপিয়ে গিয়েছিল তাঁর প্রায়-নীরব উপস্থিতি, তাঁর অভিব্যক্তি।
আরও পড়ুন
সঙ্গী কুকুর, ৭ বছর পায়ে হেঁটে বিশ্বভ্রমণ তরুণের
সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়। নামটা চেনা ঠেকছে না নিশ্চয়ই? তবে মাস্টারমশাই-এর চরিত্রটিকে বাস্তবের রূপ দিয়েছিলেন তিনিই। কিন্তু যাঁকে নিয়ে এত চর্চা, এত আলোচনা হয়েছিল সে-সময়— কীভাবে এত দ্রুত তিনি হারিয়ে গেলেন বিস্মৃতির আড়ালে? কেন তাঁর নামটুকুও মনে রাখল না বাংলার চলচ্চিত্রজগৎ? সেই প্রসঙ্গেই ফেরা যাক বরং।
টলিপাড়ায় যেমন তাঁর উপস্থিতি চমকে দিয়েছিল পরিচালককে। সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর, তেমনই আকস্মিকভাবেই তরুণ মজুমদারের কাছে হাজির হয়েছিলেন সন্তোষবাবু। সেই নিরীহ, নিঃস্পৃহ চাহনি। ঠোঁটে মৃদু হাসি ধরে রেখে, চটের ব্যাগ থেকে বার করে এনেছিলেন দুটো পেয়ারা, একটা আপেল, একজোড়া কলা। ঋণস্বীকারের এমন অদ্ভুত ভঙ্গি অবাক করেছিল স্বয়ং পরিচালককেও। আরও অবাক করেছিল তাঁর শান্ত কণ্ঠস্বর, ‘আমি ফিল্ম লাইন ছেড়ে চলে যাচ্ছি চিরদিনের জন্য’। হ্যাঁ, তারপর টলিপাড়ায় আর কোনোদিনও খোঁজ মেলেনি তাঁর। ‘বালিকা বধূ’-ই তাঁর শেষ অভিনীত সিনেমা। শুধু তাই নয়, বলতে গেলে এই সিনেমাতেই প্রকৃত অভিনেতা হিসাবে অভিষেক হয়েছিল তাঁর।
আসলে ষাট-সত্তর-আশির দশকে সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায় বাবুর মতো হাজার হাজার মানুষ বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতায় ভিড় জমাতেন অভিনয়ের জন্য। নাম লেখাতেন এক্সট্রার খাতায়। ডায়লগ নেই, নেই কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও। যৎসামান্য পারিশ্রমিক মিলত বটে। আর তাঁদের জন্য বরাদ্দ থাকত দুটো ঠাণ্ডা শিঙাড়া, চপ। নামের বদলে নম্বরই হয়ে উঠত তাঁদের পরিচয়।
আজীবন এক্সট্রার ভূমিকা পালন করা সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এমন এক পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ও ছিল একপ্রকার ইউটোপিয়া। সেখানে অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পেয়েছিলেন প্রবীণ অভিনেতা। প্রথমবার, তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছিল চলচ্চিত্র সমালোচকদের মুখেও। জীবনের বাকি সময়টা এই স্মৃতিকেই আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিলেন সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তরুণ মজুমদারকে অকুণ্ঠভাবেই জানিয়েছিলেন, এই ভালোবাসা পাওয়ার পর আর এক্সট্রার জীবনে ফিরতে পারবেন না তিনি। বরং, তিনি বলতে চান তাঁর কেরিয়ার শেষ হয়েছে মাস্টারমশাই-এর চরিত্রে অভিনয় করেই। না, তারপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাননি ‘বালিকা বধূ’-র পরিচালকও। আক্ষরিক অর্থেই চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছিলেন সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর মনে রাখিনি আমরাও। অন্যদিকে 'বালিকা বধূ' চলচ্চিত্রের প্রিন্টও হারিয়ে গেছে সম্পূর্ণভাবে।
শুধুই কি সন্তোষবাবু? প্রথাগতভাবে অভিনেতা নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিপরীতে গেলে এহেন বহু অখ্যাতনামা শিল্পীদেরই দাঁড়াবার জায়গা করে দিয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। আমরা না মনে রাখলেও, স্বয়ং পরিচালক তাঁদের কথা লিখে গেছেন স্মৃতিচারণায়, নিজের বই-তে। সেখানেই বাংলা চলচ্চিত্রের আর পাঁচটা পরিচালকের থেকে বোধ হয় আলাদা হয়ে যান তরুণ…
তথ্যঋণঃ
১. সিনেমাপাড়া দিয়ে, তরুণ মজুমদার
২. বাতিল চিত্রনাট্য, তরুণ মজুমদার
৩. গবেষক বাবুল মণ্ডল
Powered by Froala Editor