২০১৬ সালের ২২ মার্চ। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৭টা বেজে ৫৫ মিনিট। বসন্তের প্রথম রোদ স্নান করিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ব্রাসেলস বিমানবন্দরকে। আর সোনালি রোদের ছটায় যেন আরও মায়াবী রূপ নিয়েছে ব্রাসেলস। তবে মুহূর্তেই ঘেঁটে গেল সবকিছু। হঠাৎ, প্রচণ্ড আওয়াজে কেঁপে উঠল বিমানবন্দরের মাটি। শান্ত, স্নিগ্ধ সকালটার চেহারা বদলে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। বিমানবন্দর জুড়ে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য মৃতদেহ, আর্তনাদ আর রক্তস্রোত।
বছর পাঁচেক আগে এভাবে আইএসের আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল বেলজিয়ামের অন্যতম বিমানবন্দরটি। আর সেই সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার হয়েছিলেন বছর ১৭-র এক মার্কিন তরুণী। বেলজিয়াম ভ্রমণের পর দেশে ফেরার জন্যই তিনি অপেক্ষারত ছিলেন ব্রাসেলস বিমানবন্দরে। কিন্তু বাড়ি ফেরার পরিবর্তে তাঁর ঠিকানা হয়ে উঠল হাসপাতাল।
বেয়াত্রিচে দে লাভালেটে। শরীরের একাধিক অংশ ঝলসে যাওয়া তো বটেই, বিস্ফোরণের কারণে দুটি পা-ই বাদ দিতে হয়েছিল মার্কিন কিশোরীটিকে। পাশাপাশি মেরুদণ্ড এবং সুষুম্নাকাণ্ডেও বড়ো আঘাত কেড়ে নিয়েছিল তাঁর চলচ্ছক্তি। কিন্তু হার মানেননি বিয়াত্রিচে। বরং, প্রবল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সেদিন ব্রাসেলস বিমানবন্দরে দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই মার্কিন কিশোরী আজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন টোকিও প্যারালিম্পিকের মঞ্চে। তাও সাধারণ কোনো খেলায় নয়, খোদ ঘোড়সওয়ারে।
নিজের বাড়িতে খামার থাকায়, অশ্বারোহণের সঙ্গে দীর্ঘ পারিবারিক সম্পর্ক তো ছিলই। ফলত, মাত্র ৩ বছর বয়সেই অশ্বচালনা শিখেছিলেন বিয়াত্রিচে। তারপর ১২ বছর বয়সে প্রথম হাতেখড়ি ক্রীড়াক্ষেত্রে। পেশাদার স্যাডেলে বেশ হাত পাকিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরই এক লহমায় বদলে যায় সবকিছু।
আরও পড়ুন
একই দিনে ৩ বার বিশ্বরেকর্ড, প্যারালিম্পিক জ্যাভলিনে স্বর্ণজয় সুমিতের
সম্প্রতি, এক সাক্ষাৎকারে বিয়াত্রিচে জানিয়েছেন, তাঁর এই ঘুরে দাঁড়ানোর পিছনে পরিবারের পাশাপাশি অন্যতম অবদান রয়েছে তাঁর পোষ্য তথা কৈশোরের ছায়াসঙ্গী ডিডি-র। হ্যাঁ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হওয়ার পর, তাঁর পোষ্য অশ্বটিও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল হাসপাতালে। তবে প্রবেশাধিকার মেলেনি তার। বরং, হুইলচেয়ারে করে পার্কিং স্লটে গিয়েই তাকে দেখে এসেছিলেন বিয়াত্রিচে। আর বেড়ে গিয়েছিল পুনরায় মাঠে নামার খিদে।
আরও পড়ুন
প্যারালিম্পিক শ্যুটিং-এ স্বর্ণপদক, ইতিহাস গড়লেন রাজস্থানের অবনী
খানিক সুস্থ হওয়ার পর, কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর, পুনরায় স্যাডেলে প্রত্যাবর্তন করেন মার্কিন তরুণী। আর তাঁর সেই লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ সঙ্গী ছিল ডিডি নামের ঘোড়াটি। আজই প্যারালিম্পিকে অংশ নিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যারা-ড্রেসেজ দল। যে দলের অন্যতম প্রতিনিধি বিয়াত্রিচে। না, সেখানে ডিডি থাকবে না তাঁর সঙ্গে। বদলে ১৪ বছর বয়সী ডাচ ওয়ার্মব্লুড ‘ক্লার্ক’-ই তাঁর বাহন। তুরুপের তাসও বটে। তবে এই পুনরুত্থান, ঘুরে দাঁড়ানো সবটাই ডিডিকে উৎসর্গ করেছেন মার্কিন তরুণী। পদক আসুক আর না-ই আসুক, বিয়াত্রিচের এই লড়াইয়ের গল্পই এখন অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বিশেষভাবে সক্ষম হাজার হাজার মার্কিন তরুণ-তরুণীকে…
আরও পড়ুন
টোকিও-য় আফগানিস্তানের দুই খেলোয়াড়, প্যারালিম্পিক মঞ্চে রূপকথার জন্ম
Powered by Froala Editor