বাংলার জামাই তিনি, ভোজনরসিক ও নেশায় ব্যোম - ‘ভুঁড়িওয়ালা’ শিবকে এভাবেই আপন করেছি আমরা

তিনি একদিকে যেমন সৃষ্টি করেন, অন্যদিকে প্রলয়ও আনেন। শান্ত হয়ে পাহাড়ের নির্জনে বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন, আবার পরক্ষণেই ডমরু আর ত্রিশূল হাতে রুদ্ররূপ ধারণ করেন। দেবাদিদেব শিব ভারতের ধর্মে-সংস্কৃতিতে জড়িয়ে রয়েছেন এভাবেই। সিনেমায়, গল্প-কথায়, পৌরাণিক আখ্যানের হাত ধরে ঘরে ঘরে প্রবেশ করেছেন তিনি। আর বাংলা? হ্যাঁ, সেখানেই বিরাজ করছেন তিনি। কিন্তু তাঁর বঙ্গ রূপটি যেন খানিক আলাদা বাকিদের থেকে! খানিক কেন, বলা ভালো বেশ অনেকটাই। শিবের নায়কপ্রতিম ইমেজের বাইরে গিয়ে এখানে যেন তিনি হয়ে উঠেছেন ঘরের ছেলেটি।

একটা সময় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতে বেড়ে গিয়েছিল। তাতে যেন খানিকটা পিছনেই চলে গিয়েছিল সনাতন ধর্ম। অবশ্য তার আগেই বা খানিক সেই সময়েরই আশেপাশে বাংলায় শিবের প্রবেশ বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। বাণগড়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে যে চিহ্ন পাওয়া যায়, সেটা দেখে প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা এটি সম্ভবত মৌর্য ও সুঙ্গ যুগের। পরে গুপ্ত আমলে ও বিশেষ করে শৈব উপাসক রাজা শশাঙ্কের আমলে এর প্রাধান্য বাড়তে থাকে।

আরও পড়ুন
হাইকোর্ট চত্বরে অধিষ্ঠান তাঁর, ভক্তদের জন্য সদা জাগ্রত ‘হাইকোর্টেশ্বর’ শিব

কিন্তু এ তো তথাকথিত শিবলিঙ্গের কথা। বাংলার ঘরের শিবের উপস্থাপনা শুরু হয় মঙ্গলকাব্য ও লোক-সংস্কৃতির হাত ধরে। সেখানে নানা সময়, নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি। দীনেশচন্দ্রের মত অনুযায়ী, “যখন বৌদ্ধ-যুগের সংসার-বিরাগের ভূত আমাদের ঘাড় হইতে নামিল, তখন দীর্ঘ যুগের কঠোর বৈরাগ্যের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ঘর-গৃহস্থালীর খুঁটিনাটি লইয়া ধর্ম্মপুস্তক রচনা হইতে লাগিল। প্রথম উপাস্যস্থল শিব ঠাকুর, তিনি চাষাদের হাতে পড়িয়া চাষা হইলেন।” লক্ষ্মণ সেন ও তাঁর পরবর্তী আমলের শিবায়নগুলিতে এভাবেই উঠে এসেছেন ‘চাষা শিব’। তিনি এখানে মাটি কর্ষণ করছেন, ত্রিশূল বন্ধক রেখে লাঙ্গল কিনছেন, তারপর ফসলও বুনছেন। সবদিক দিয়েই একেবারে ঘরের মানুষ হয়ে উঠছেন এক দেবতা, এমনই ছোঁয়া দেখতে পেল বঙ্গসমাজ।

যামিনী রায়ের আঁকা শিব

শিব কে? প্রশ্নটা সহজ হলেও, উত্তরটি সহজ নয়। এক একজনের কাছে এক একভাবে হাজির হয়েছেন দেবাদিদেব। সেখান থেকেই তাঁর নানা রূপ, নানা আঙ্গিক উঠে এসেছে কালে কালে। বাংলার মঙ্গলকাব্যও একটি রূপ দিয়েছে। পাহাড়ে তপস্যারত যোগী বা আদিশক্তি নয়, বরং রীতিমত আদুরে জামাই তিনি। যিনি আমিষাশী, আবার যাকে নিয়ে মজাও করা যায়। ঠিক বাড়ির ছেলের সঙ্গে যে আচরণ আমরা দেখে থাকি। এখানেই উঠে আসবে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের আখ্যান। শিবের খিদে পেয়েছে। অন্নদা রাঁধতে বসেছেন। সেই পদের বিবরণ দিয়েছেন ভারতচন্দ্র -

“কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝাল ঝোল রসা।
কালিয়া দোলমা বাগা সেকচী সমসা।।
অন্ন মাংস সীকভাজা কাবাব করিয়া।
রান্ধিলেন মুড়া আগে মসলা পুরিয়া।।”

ভালো করে লক্ষ করেছেন? কালিয়া, দোলমা-সহ নানা পদের সমাহার শিবের খাবারে। এমনকি রয়েছে ‘সীকভাজা কাবাব’, যাকে আজকের দিনের শিককাবাবের সঙ্গে তুলনা করাই যায়। হাজার হোক, ঘরের লোক তো! তাঁকে কি যা-তা খেতে দেওয়া যায়?

নন্দলাল বসুর আঁকা শিব

এই অন্নদামঙ্গলেই শিব হাজির হয়েছেন বুড়া শিব হিসেবে। রায়গুণাকর বলছেন -

"কেহ বলে ওই এল শিব বুড়া কাপ।
কেহ বলে বুড়াটি খেলাও দেখি সাপ।।
কেহ বলে জটা হৈতে বার কর জল।
কেহ বলে জ্বাল দেখি কপালে অনল।।
কেহ বলে ভাল করি শিঙ্গাটি বাজাও।
কেহ বলে ডমরু বাজায়ে গীত গাও।।
কেহ বলে নাচ দেখি গাল বাজাইয়া।
ছাই মাটি কেহ গায় দেয় ফেলাই।।
কেহ আনি দেয় ধুতুরার ফুল ফল।
কেহ দেয় ভাঙ্গ পোস্ত আফিঙ্গ গরল।।
আর আর দিন তাহে হাসেন গোসাঁই।
ও দিন ওদন বিনা ভাল লাগে নাই।।”

কখনও বলা হচ্ছে, বুড়া শিব, তোমার সাপটিকে খেলাও। আবার বলা হচ্ছে, বুড়া শিব জটা থেকে জল বার করো (গঙ্গাকে নিজের জটায় ধারণ করেছিলেন মহাদেব; সেই প্রসঙ্গও লোকসাহিত্যে উঠে এসেছে)। এইভাবেই নানা আবদারে, আদরে আপ্যায়ন করা হচ্ছে তাঁকে। নিপাট ঘরোয়া ছবি। একেই একবার মেলান নিজেদের জীবনের সঙ্গে। বাইরে থেকে কেউ এলে আমরা যেমন বলি এটা দেখাও, ওটা দেখাও। ঠিক সেই কথাই যেন উঠে এসেছে। শিব এখানে দূরের অজ্ঞাত কোনো সাধক নন, বরং একেই অভ্রান্তভাবে চিনেছে বাংলা। কাছের করে নিয়েছে।

শুধু কি লেখা? ছবিতেও উঠে এসেছেন তিনি। কালীঘাটের পটচিত্রই হোক, বা পরবর্তীতে যামিনী রায়ের চিত্র— সবখানেই অন্যতম প্রধান শিব। তবে, সচরাচর যেরকম শৈবচিত্র দেখে অভ্যস্ত আমরা, এটা তার থেকে আলাদা। এখানে শিবের ‘নায়কোচিত’ বলশালী চেহারা নয়, বরং খানিক স্থূলত্বের দিকে গেছে। সহজ বাংলায় বললে, এই শিবের ভুঁড়ি বিদ্যমান। গাঁজা খেয়ে, নেশা করে চোখ লাল করে পড়ে থাকেন। আবার কখনও সেই শিবই জমিতে চাষের কাজ করছেন। পরে নন্দলাল বসু’র ছবিতেও ফুটে উঠেছে বিষপাত্র হাতে শিব। পাঠকদের মনে আসতে পারে মালদহের গম্ভীরার প্রসঙ্গও। শিব এখানে সাধারণ মানুষের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, আনন্দের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের কথা শোনেন, উপদেশ দেন। আবার মজাও করেন। মানুষরাও ‘নানা’-র কাছে সব কিছু বলে। এইভাবেই বিভিন্ন আঙ্গিকে, দৃষ্টিকোণ দিয়ে তিনি উঠে এসেছেন বাংলার সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে। আর, আজও তা বহমান, প্রবাদে হোক বা দৈনন্দিন উদাহরণে...

কালীঘাটের পটচিত্রে শিব


ঋণ-
১) বাংলা কাব্যে শিব/ গুরুদাস ভট্টাচার্য
২) ফেসবুক

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More