“…ডিক্লেয়ারিং দ্য স্লোগান অফ বন্দেমাতরম ইললিগ্যাল ওয়াজ মিসকন্ট্রাকশন অফ ল।” কথাগুলি লিখছেন খোদ বড়োলাট মিন্টো। এ কী লিখলেন মিন্টো! বন্দেমাতরম বে-আইনি ঘোষণা করা মানে আইনের অপব্যাখ্যা! তাহলে কি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আবেগের প্রতিই পক্ষপাতিত্ব করে ফেলছেন অত্যাচারী এই ব্রিটিশ ভাইসরয়? লর্ড মিন্টোর পক্ষে এমন অবস্থা নেওয়া যে কোনোদিনই সম্ভব নয়, সেটা সকলেই বুঝবেন। আসলে পরিস্থিতি যে তখন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সামান্য একটি গানের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া একটি শব্দ যে এত তীব্র রূপ ধারণ করতে পারে, সেটা হয়তো ব্রিটিশ শাসকরা সহজে আন্দাজ করতে পারেননি। কিন্তু দেখতে দেখতে ‘বন্দেমাতরম’ হয়ে উঠেছে দেশের জাতীয় মন্ত্র। একে দমন করতে ব্রিটিশ সরকার তো কম চেষ্টা করেনি।
শুধুমাত্র ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ নিয়ে একের পর এক সার্কুলার জারি করেছে ব্রিটিশ প্রশাসন। আর তার প্রতিক্রিয়াতে গড়ে উঠেছে অ্যান্টি-সার্কুলার সমিতিও। এমনকি গানের কথা বা স্লোগান থেকে বন্দেমাতরম ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে লিখিত চিহ্ন রূপেও। সমকালীন নানা তথ্য থেকে জানা যায়, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে বন্দেমাতরম লেখাঙ্কিত উত্তরীয়, শাড়ির প্রচলনও শুরু হয়ে যায়। আর এই সবই ছিল ব্রিটিশ সরকারের চক্ষুশূল। হয়তো প্রশাসনকে বিব্রত করতেই এমন পথ বেছে নিয়েছিলেন স্বরাজপন্থীরা।
১৮৭৫ সালে লেখা হয় ‘বন্দেমাতরম’ গানটি। এরপর নানা জটিলতার মধ্যে দিয়ে ১৮৮২ সালে প্রকাশিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সংযোজিত হয়। আনন্দমঠ উপন্যাসটি নিয়েও কম মামলা সামলাতে হয়নি সাহিত্যসম্রাটকে। ব্রিটিশ সরকারের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য উপন্যাসে একাধিকবার শব্দ পরিবর্তন করেছেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্খা জায়গা করে নেয় এই উপন্যাস এবং এই গানের মধ্যেই। কোনো আড়াল সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বিশেষ করে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময়েই এই ধ্বনি স্লোগানের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন, “শাসকগণ আমাদের দেশকে দ্বিধাবিভক্ত করায় আমরা যখন জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করি, সেই সংগ্রামের সময় ইহা প্রকৃতপক্ষে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে প্রচলিত হয়। পরবর্তী সময় বন্দেমাতরম যখন জাতীয় শ্লোগানে পরিণত হয়, তখন ইহার জন্য আমাদের বহু বিশিষ্ট বন্ধু যে আত্মত্যাগ করিয়াছে, তা ভুলিতে পারি না।” ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের বর্ণনাতেও উঠে এসেছে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে দিতে পুলিশের লাঠির আঘাতে বিপ্লবীর প্রাণত্যাগ বা ফাঁসির দড়ি গলায় পরে নেওয়ার দৃশ্য।
১৯০৫ সালের ১০ অক্টোবর, অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবিত দিনের কয়েকদিন আগে, জারি করা হয় কার্লাইল সার্কুলার। এই সার্কুলার অনুযায়ী, কোনো ছাত্র যদি বন্দেমাতরম ধ্বনি দেয় তাহলে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে। ওই বছরই ঢাকার চিফ সেক্রেটারি লায়নের সার্কুলার অনুযায়ী পূর্ববঙ্গে নিষিদ্ধ হল বন্দেমাতরম ধ্বনি। আর এই সমস্তকিছুর প্রতিক্রিয়াতেই গড়ে উঠল অ্যান্টি-সার্কুলার সমিতি। আরও কঠোর হল প্রশাসন। শুধু বহিষ্কার নয়, বরং বিদ্যালয়ের গ্রান্ট অথবা বিশেষ পরিস্থিতিতে অনুমোদন বাতিল করা হবে বলেও জানিয়ে দিল সরকার। অর্থাৎ এবার চাও এসে পড়ল সরাসরি শিক্ষকদের উপর। কিন্তু এতকিছু করেও বন্দেমাতরম ধ্বনিকে প্রতিরোধ করা যায়নি। বাধা যত শক্ত হয়েছে, ততই ছড়িয়ে পড়েছে এই মন্ত্র।
আরও পড়ুন
ব্রিটিশ হয়েও সরকারের বিরোধিতা, ভারতের ‘কমিউনিস্ট এজেন্ট’ জন ক্যারিটের গল্প
১৯০৬ সালের ১৪ নভেম্বর ‘বন্দেমাতরম’ নামের একটি আলাদা সম্মেলনের আহ্বান জানানো হয়। পুলিশের নির্মম অত্যাচার এবং লাঠিচার্জের মুখেও সেদিন বন্ধ হয়নি স্বদেশিদের মন্ত্র। দেখতে দেখতে সারা বাংলা এবং বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে এই মন্ত্র। বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়ার অপরাধে নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করা হয় বহু নাবালক স্কুল-পড়ুয়াকে। শেষ পর্যন্ত এক বিকল্প পদ্ধতি বেছে নিলেন স্বদেশিরা। বন্দেমাতরম ধ্বনিকেই পোশাক করে তুললেন তাঁরা। ধুতি বা শাড়ির পারে নকশা করে লেখা হতে থাকে বন্দেমাতরম। নেতাদের উত্তরীয়তেও দেখা যায় বন্দেমাতরম লেখা। স্বদেশিদের পোশাক কেড়ে নিতেও কসুর করেনি ব্রিটিশ পুলিশ। শোনা যায় ঢাকা শহরের একটি বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ, কারণ বাড়ির একটি দেয়ালে লেখা ছিল বন্দেমাতরম মন্ত্র। কিন্তু প্রতিবাদের আগুন ক্রমশ ছড়িয়েই পড়েছে।
আরও পড়ুন
কলকাতা আক্রমণ করতে আসছে রাশিয়া, আতঙ্কে ইংরেজরা, সাহায্য প্রার্থনা বড়লাটের
শেষ পর্যন্ত প্রশাসনিক ব্যর্থতার সুরই ফুটে ওঠে বড়োলাট মিন্টোর কথায়। সেই কথা আগেই বলা হয়েছে। তবে শুধুই ব্রিটিশ সরকারের কোপে পড়েছে বন্দেমাতরম ধ্বনি, এমনটা নয়। পরবর্তীকালেও এই নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। অনেকেই এই গানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছেন। উঠে আসে পৌত্তলিকতার প্রসঙ্গও। এমনকি কংগ্রেসের অধিবেশনেও পরে এই গানের শেষাংশ গাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৭ সালে এই বিষয়ে স্থায়ী সিদ্ধান্ত নেয় দলের ওয়ার্কিং কমিটিও। ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি বজায় রাখতেই স্বাধীন ভারতে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। অবশ্য পরবর্তীকালে যাঁরা বন্দেমাতরম গানের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদেরও রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে জড়িয়ে ছিল এই মন্ত্র। বন্দেমাতরম ছাড়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কল্পনাই করা যায় না।
আরও পড়ুন
রামমোহন চিঠি লিখলেন বড়লাটকে, সংস্কৃত কলেজে ঠাঁই হল হিন্দু কলেজের
তথ্যসূত্রঃ ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই, শিশির কর
Powered by Froala Editor