আঠেরো শতকের শেষের দিক। ভারতের স্বাধীনতার সূর্য ততদিনে অস্তমিত। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা তখন একটু একটু করে ইংরেজ সাহেবদের মনের মতো করে সেজে উঠছে। তার মধ্যেই চলছে জনজীবন। সকালে উঠে তখনও শহরের ঘাটগুলোয় ভক্তিভরে স্নান সারেন অনেকে। একদিন ভোরে সেই ঘাটে আগত মানুষরা দেখলেন এক অবাক করা দৃশ্য। খালি পায়ে, উত্তরীয়, ধুতি-পাঞ্জাবী পরে, ঘাট থেকে উঠে আসছেন এক ইউরোপীয় সাহেব। সদ্য স্নান সেরেছেন। কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা। সাহেবের সঙ্গে রয়েছে একটি ছোট্ট কৃষ্ণের বিগ্রহ।
সাতসকালে এমন চমৎকার দৃশ্য দেখে অবাক হতেই হয়। তবে এই একদিন নয়। এই সাহেব এর আগেও বেশ কয়েকবার ঘাটে স্নান সেরেছেন। নিজে স্নান করে, প্রিয় কৃষ্ণ-কে স্নান করিয়ে তারপর বাড়ি যেতেন তিনি। সেই সময় ব্রিটিশ রাজত্বে এই জিনিস কল্পনা করা অসম্ভবই ছিল খানিক। কিন্তু, শহরের নাম যে কলকাতা! এখানে কত আশ্চর্য সব গল্প তৈরি হয়। সেরকমই একটি গল্পের নায়ক এই ইউরোপীয় সাহেবটি। কিন্তু মনে প্রাণে তিনি ছিলেন ভারতীয়, ছিলেন হিন্দু দর্শনের প্রতি আস্থাশীল। তিনি চার্লস ‘হিন্দু’ স্টুয়ার্ট।
পলাশি যুদ্ধের মাত্র এক বছর পর, ১৭৫৮ সালে আয়ারল্যান্ডে জন্ম হয় চার্লস স্টুয়ার্টের। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই তিনি যোগ দেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে। সেই সূত্রেই ১৭৭৭ সালে চলে আসেন ভারতে, কলকাতায়। সেই যে এলেন, আর ফিরলেন না। কলকাতার রক্তে মিশে গেলেন তিনি। জীবন শুরু হয়েছিল সাধারণ সৈনিক হিসেবে। সেখান থেকে একসময় হয়ে যান মেজর জেনারেল। কিন্তু শুধু এইটুকু বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। কারণ, চার্লস স্টুয়ার্টের জীবন যে এর থেকেও অনেক বড়।
নিজের খরচায় ভারতীয় পুরাতত্ত্বের বিভিন্ন নিদর্শন সংগ্রহ করতেন তিনি। তার মধ্যে বেশিরভাগটাই ছিল হিন্দু দেবদেবীর। তখন থেকেই হিন্দু ধর্মের প্রতি, হিন্দু দর্শনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ। যত দিন যায়, সেই আকর্ষণ আরও গভীর হতে থাকে। নিবিড়ভাবে পড়তে থাকেন উপনিষদ, পুরাণ-সহ অন্যান্য গ্রন্থগুলি। ক্রমশ জড়িয়ে পড়েন তার সঙ্গে। সেইসঙ্গে ছিল তাঁর প্রিয় গোপালের বিগ্রহ। কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর ছিলেন তিনি। অত্যন্ত যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে সেই বিগ্রহের সেবা করতেন। এমনকি, নিজে বলেওছিলেন -
“Whereever I look around me, in the vast ocean of Hindu mythology, I discover Piety….Morality…..And as far as I can rely on my judgement, it appears the most complete and ample system of Moral Allegory that the World has ever produced.”
সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে গেলে চোখ পড়বে একটি বিশেষ সমাধির দিকে। অন্যান্য সমাধির থেকে একটু আলাদা। গঠন অনেকটা মন্দিরের মতন। হ্যাঁ, এর নীচেই চিরঘুমে শুয়ে আছেন চার্লস ‘হিন্দু’ স্টুয়ার্ট। সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিক থেকে সাধারণ মানুষ— সবার প্রিয় মানুষ ছিলেন যিনি। শুধু চার্লসই নন, তাঁর সঙ্গে শুয়ে আছে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা। গোপালের বিগ্রহ। ভক্ত আর ভগবান একই সঙ্গে শেষশয্যায় শুয়ে আছেন, এর থেকে অভূতপূর্ব দৃশ্য আর কি হতে পারে! হ্যাঁ, এটাই কলকাতা। যার প্রতিটা গলিতে লুকিয়ে আছে এক একটা গল্প।