লকডাউনের গপ্পো ১০

মফস্বল শহরে মেঘ একটু বেশি ঝুঁকে আসে। রিমিতার তাই মনে হত ছোটোবেলা থেকে। এখন অনেকদিন পর রোজ বাড়ি। এমনটা প্রায় হয় না। বরং ঘুরে বেড়াতে হয়। দুটো প্রান্তে। এক প্রান্ত রিমিতার মফস্বল ছাড়িয়ে অন্য জেলায়। যেখানে সে গবেষণা করে। আরেক প্রান্ত... সেও অন্য জেলা। কলকাতায়। যেখানে রিমিতাকে যেতে হয়। কাজের জন্য। আর রিমিতার বাড়ি ঠিক দুটোর মাঝখানে। লকডাউনের জন্য, প্রান্ত থেকে প্রান্তে ছোটা মেয়েটা কেন্দ্রে এসে বসেছে। মানে বাড়িতে। আর বাড়ি মানেই একটা এক চিলতে ছাদ। কয়েকটা ফুলের গাছ। আর একটা বিশাল আকাশ। যার দুদিকে মেয়ে ছুটে যায় রোজ। অথচ এখন দুদিকের মেঘ আর দুদিকের তারা... এদের সঙ্গেই তার গল্প ।

রেললাইনের ধারে বাড়ি। ট্রেন গেলে ঝাঁকুনি আসে। লক ডাউনে তাও প্রায় বন্ধ। সন্ধে হলেই অন্ধকার। রিমিতার বাড়ির সামনে বাবুয়া জেঠুর দোকান। বাবুয়া জেঠু দোকান খোলে না এখন। তাই বাড়ির সামনেটা অন্ধকার। ছাদে উঠলে স্টেশনের আলো দেখা যায়। আর দেখা যায় তারাদের। ওরা ছোটো থেকেই রিমির বন্ধু।

- ডান হাতের তারা, জানো আজ খবরে বলেছে তোমাদের ঐদিকে করোনা হটস্পট।

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ৯

- বাঁ হাতের তারা, ওদিকে করোনার টেস্টিং কিট পৌঁছল কিনা জানো কিছু? আমাদের ইউনিভার্সিটি কি পুরো বন্ধ? কেউ যায় না? না? খবর জানো?

তারার কাছ থেকে, মেঘের কাছ থেকে রিমি খবর পায়। নতুন কোন ঘাসফুল ফুটেছে গোলাপবাগে। কোন ভ্রমর সেখানে মধু খেতে এল। মৃত্যুর খবর পায় না। মহামারীর খবর ? উঁহু। তাও নয়।

তা বলে খবর কি আসেনা? খবরের পিঠে আছে হাওয়ার ডানা। কে আটকাবে তাকে! রোজ আসে। খারাপ খবর। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার খবর। প্রধানমন্ত্রী সার্কাসের তাঁবু খাটিয়েছেন। সেখানে নিত্যনতুন বাঁদর নাচ। সেই নাচের খবর। কোন অভিনেত্রী তার ফর্সা হাত বুলিয়ে নামিয়েছেন সুগন্ধি খাবার... তার খবর। আর অনেক মানুষের না খেতে পারার খবর। পায়ে হেঁটে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার খবর। তাদের কীটনাশক দিয়ে স্নান করানোর খবর। খবরের তো আছে হাওয়ার ডানা। কে আটকাবে তাকে!

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ৮

- কাল রাতের ঝড়ে একটা পাখির বাসা ভেঙে গেছে। বাঁ হাতের তারা এইমাত্র জানালো। বাসায় দুটো ছোটো বাচ্চা ছিল। মা ওদের মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে। নতুন বাসা। নতুন খড়। নতুন কুটো।

- আজ সকালে উত্তরের মাঠে, একটা ঘাসের ডগা থেকে শিশির পড়ছিল। ডান হাতের তারা বলল।

ডান হাতের তারা, বাঁ হাতের তারা। ডান হাতের মেঘ। বাঁ হাতের মেঘ। এমন কত খবর বিছিয়ে দেয় সমস্ত রাত। সেই খবরের চাদর গায়ে দিয়ে রিমি ঘুমায়। ভোরের হাওয়া সেই চাদরকে আরেকটু তুলে দেয় রিমির গায়ে। তারপর কপালে নেমে আসা চুল আঙুল দিয়ে সরিয়ে, রিমির মাথায় হাত বুলিয়ে সে চলে যায় ডান দিকের আকাশে।

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ৭

সকালে রিমির ঘুম ভাঙল ঋতর মেসেজে।

- আজ সারারাত ডিউটি ছিল। জানিসই তো আমাদের তো করোনা সেন্টার। কাল আরও ষাটজন নতুন করে ভর্তি হয়েছে। ভালো লাগছে না রে।

রিমির বুক কেঁপে ওঠে। না। ওই ষাটজনের জন্য না। নিজের মানুষটার জন্য। ডানদিকের আকাশের তলায় যে শহর, যেখানে রিমি কাজের জন্য যায়, সেইখানে থাকে ও। ও আর ওর মত অনেক অল্পবয়সী ডাক্তার,নার্স.. স্বাস্থ্যকর্মী। তাদের দিনে ছুটি নেই। রাতে ঘুম নেই। হাত ধুয়ে ধুয়ে চামড়া উঠে যাচ্ছে। ওরা লড়াই করছে। এক অন্ধকার দৈত্যের মুখ ফিরিয়ে দিতে চাইছে আলোর দিকে। কিন্তু... পারছে না। হেরে যাচ্ছে। প্রত্যেক দিন। বারবার। তবু হার মানছে না। ওরা অনেকদিন বাড়ি ফেরেনি। ওরা অনেকদিন বাড়ি ফিরবে না। ঋতও তো এই মফস্বলের। লাইনের ঐপারে গঙ্গা। তার ধারে ওর বাড়ি। ওখানে ও আসেনি অনেকদিন। ওখানে ও একদিন আসবে। রিমি জানে।

আরও পড়ুন
লকডাউন এর গপ্পো ৬

- তুই সাবধানে থাক। নিজের যত্ন নে।

এই কটা কথা টাইপ করে রিমি বাথরুমে গেল। একজস্ট ফ্যানের ঘুপচি দিয়ে সকাল ঢুকে পড়েছে স্নানের ঘরে। বালতিতে জল ভরতে ভরতে রিমি বুঝতে পারল, আজকে কী বার ওর মনে নেই।

এইরকম হচ্ছে কদিন। দিন গুলিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল জানিয়ে দেয় বার, বছর, মাস তারিখ। তবু গুলিয়ে যায়। ওগুলো কেমন একটা নিভে আসা সংখ্যা। রিমি ভাবে। ভাবে আজ কী রান্না হবে। আলু আছে খানিক। চাল ও। ডিম কি পাওয়া যাবে? এইসব ভাবতে ভাবতে ও বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। পুরোনো কোনো বন্ধুকে ফোন করবে? কাকে করা যায়?

রিমি কাউকে ফোন করল না। চায়ের জল বসিয়ে গীতবিতান বের করে নিল। অনেকদিন গান পড়ে না ও। শোনে তো রোজই। তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে...

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ৫

রিমির হঠাৎ মনে হল গলাটা ব্যথা ব্যথা করছে। জ্বর জ্বর। তবে কি...

ঋতকে ফোন করব ? কেউ তো নেই এখন। কী হবে! কে এম্বুলেন্স ডেকে দেবে। ডান হাতের তারা? বাঁ হাতের তারা! ওরা তো সকালে ঘুমায়। রাতে আসে। তাহলে কী করবে রিমি এখন। ভাবতে ভাবতে রিমি আবার শোয়ার ঘরে গেল। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিল। বড়ো ক্লান্ত লাগছে। চোখটা ভারী ভারী।

- ওঠ। সন্ধে হল। খাবি না? ডানদিকের তারা রিমিকে ডেকে তুলল।

বাঁ দিকের তারা বলল,ওর মনে হয় শরীরটা খারাপ। জানিস আজ কোত্থেকে ঈশানের জঙ্গলে একটা বাবুই এসেছে। এসেই শুরু করে দিয়েছে জোগাড়যন্ত্র। বাসা বুনবে আবার।

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ৪

রিমির মনে পড়ল সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। উঠে রান্নাঘরে গেল। খানিকটা মুড়ি নিয়ে এসে আবার বসল ছাদে। সূর্য ডুবলে ওর আর নীচে নামতে ইচ্ছে করে না। কত বন্ধু ওর ছাদে। ডান হাতের তারা আর বাঁ হাতের তারা তো আছেই।

ডান হাতের তারা আবার প্রেমে পড়েছে। একটা উল্কা ছুটে যাচ্ছিল। ওর কাছে আসতেই বলেছে আমার সঙ্গে থাকবি? উল্কাটা এত বদ, ভেংচি কেটে চলে গেছে। তবু ডান হাতের তারা আশা ছাড়ে নি। যদি ও ফিরে আসে!

- আ মলো যা। কেউ কোনোদিন শুনেছে উল্কা ফিরে আসে?
- যে সমস্ত কেউরা বেঁচে আছে, তাদের অনেক অনেক আগে উল্কারা সত্যি ফিরে আসত। আমি জানি।
- বাঁ হাতের তারা, আমি যদি উল্কা হয়ে যাই। রিমি বলল।
- ডানহাতের তারা বলল, ওর জ্বর হয়েছিল না। সেই থেকে উল্টোপাল্টা ভাবছে। আরে সিজন চেঞ্জের সময়। তোর তো এই সময় এমনিতেই শ্বাসকষ্ট হয়।
- মানুষের মন তো। বেশি ভাবা ওদের স্বভাব। বাঁ হাতের তারা বলল।
তারাদের দেশে আসা অত সহজ নয়। অনেক কঠিন কঠিন পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। প্রথমেই দেখা হয় তোমার ভেতরে কতটা আলো আছে।
- তাই নাকি!

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ৩

- নয়তো আর বলছি কী! তবে শুধু আলো থাকলেই তো হবে না। তোমার ভেতরে অনেক গল্প থাকতে হবে।
- গল্প দিয়ে কী হবে?
- তারাদের আসল কাজ হল রাতকে গল্প শোনানো। একেকটা তারা কয়েক হাজার বছর বেঁচে থাকে। আর মরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত রোজ রাতে ওদের গল্প বলতে হয়।
- রোজ রাতে আবার কী! তারাদের দিন রাত বলে কিছু হয় নাকি। ও তো শুধু আমাদের।
- ঐখানেই তো ভুল করলে। তোমাদের দিন যখন, তখন তো কারও না কারও রাত। আমরা তাদের গল্প শোনাই। তোমাদের রাত হলে তোমার কাছে আসি।
- তোমরা ভুলভাল কথা বল। হবেই তো। তোমরা তো আর ইস্কুলে পড়োনি। মায়ের বকা খেয়ে পড়া মুখস্থ করোনি। তোমাদের দোষ নেই।
- রিমি আমাদের অশিক্ষিত বলছে রে। ডান হাতের তারা বলল।
বাঁ হাতের তারা কিচ্ছু বলল না। চুপ করে নেমে এল রিমির কপালে….

কী লিখেছিস এইসব। হো হো করে হেসে উঠলেন ড: ঋতবীণা ব্যানার্জি। তুই তো মাস্টার। এসব পোয়েটিক হিজিবিজি নামালি কখন।
যখন আমার ডে অফ ছিল তখন। তোর কী! মাস্টার কবি হতে পারে না কেউ বলেছে!
আর তুই না বলে আমার ডায়রি ধরেছিস কেন?

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ২

- তোর ডায়রি! ওটা আমার। সামনে নাম দেখ। নতুন ডায়রি এনে রাখলাম নাম লিখে। অমনি নিজে নিয়ে নিল।
- এই সরি রে। লজ্জায় রিমিতা ঘোষের মুখ লাল হয়ে গেল। আমি ভাবলাম আমার বোধহয়।
- আমার মানেই তোর।
- মোটেই নয়।
- মোটেই হ্যাঁ।

তোরা আবার ঝগড়া শুরু করলি। একদিন বাড়িতে ডেকেছিস খাওয়াবি বলে। আর তার মধ্যে এইসব। নক্ষত্র বলে উঠল।

কৃত্তিকা রিমিতার গলা জড়িয়ে বলল, যাই বল, আমাদের রিমির হাত পরীক্ষার খাতায় নম্বর দেওয়া ছাড়াও কলম ধরে, আমরা এতদিনের বন্ধু হয়ে জানতাম না!

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ১

মহামারী শেষ হয়েছে অনেকদিন হল। আকাশ এনক্লেভের রাইট উইং-এর নক্ষত্র সেনের সঙ্গে লেফট উইং-এর কৃত্তিকা মৈত্রের বিয়েটাও অবশেষে হয়ে গেল। আর মহামারীর পর অবশেষে মানুষ তারাদের ভাষা অনেকটা বুঝতে পারে। ওদের আলো অনেক দূর থেকে এসে পড়ে মানুষের চোখে। সত্যিই আসে। নইলে ঋতবীণার বাড়ির লোক কিছুতেই মানত না। মহামারীর পর যখন ডিউটি একটু হালকা হল, তখন প্রথম রিমিতাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল ঋতবীণা। মা খানিক চুপ করে ছিলেন। তারপর বললেন, বিয়ের কার্ডটা পছন্দ করে দিবি? ছাপতে দেব।

More From Author See More