লকডাউনের গপ্পো ১৩

রিংটোনটা বেজে উঠতেই ই-প্যাডের সবুজ বোতামে আঙুল ছোঁয়ান ডঃ দাশগুপ্ত।
ইয়েস, দাশগুপ্ত হিয়ার…

না, না। আয়াম ফ্রি নাউ।

সে কী! কী ধরনের সমস্যা?

স্ট্রেঞ্জ! অ্যাজ ইফ হি ইজ টকিং অ্যাবাউট…। কথাগুলো এক্স্যাক্টলি কী বলছে বলতে পারবেন? একটু বিশদে…

আই সি… আচ্ছা, এক কাজ করুন না, অনেকদিন তো দেখাসাক্ষাৎ হয় না আমাদের। অন্বয়কে নিয়ে চলে আসুন আমার এখানে, নেক্সট সানডে। ডিনারটাও বেশ জমিয়ে করা যাবে।

ওওকে, গুডনাইট ম্যাডাম!

কল-এন্ডের রেড বাটন প্রেস করতে না করতেই ভদ্রতাসূচক হাসির রেখাটুকু মিলিয়ে যায় দাশগুপ্তের ঠোঁট থেকে। কপালে দুয়েকটা ভাঁজ দেখা দেয়। পেশেন্টদের ফোন আজকাল সচরাচর তাঁর সেক্রেটারি অত্রিই ধরে। তবে কিনা অধ্যাপক অন্বয় চক্রবর্তী আর তাঁর স্ত্রী স্বরলিপি সরকারের ব্যাপারটা আলাদা। আলাপ ভার্চুয়াল-চেম্বারেই। কিন্তু দীর্ঘদিনের পরিচয়সূত্রে এঁরা এখন প্রায় ফ্যামিলি-ফ্রেন্ড। তাঁদের যে-কোনোরকম সমস্যা দাশগুপ্তের নিখুঁত পেশাদারিত্বের মসৃণ সৌধকেও কিঞ্চিৎ বিচলিত করে।

শুতে যাওয়ার আগে গ্রিন-টির সঙ্গে বইয়ের পাতায় নৈমিত্তিক চোখ বুলনোর সময়টুকু দাশগুপ্তের কাছে সবচেয়ে উপভোগ্য। কিন্তু আজ যেন তাতেও মন নেই। দক্ষিণের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তারাভরা আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি। আকাশের যে তারাটা আজ সবচেয়ে উজ্জ্বল, সে হয়তো মরে গেছে বহু বছর আগেই। তবু আলোর রেখা পুরনো স্মৃতিভার বহন করে অক্লান্তভাবে এসে পৌঁছচ্ছে পৃথিবীতে। তার না-থাকাটাও থাকা বলে মনে হচ্ছে, কারণ মরে যাওয়ার খবর তখনও মানুষের কাছে আসেনি। যে তারা যত দূরের তার মৃত্যুসংবাদ তত দেরিতে পৌঁছয়। দাশগুপ্ত কবি-স্বভাবের লোক নন। তবু এই পর্যন্ত ভেবে শিহরণ খেলে যায় তাঁর শরীরে।

আসলে একটু আগেই তাঁর ঘর থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন অন্বয় আর স্বরলিপি। সেদিন ফোনে যেটুকু স্পষ্ট করা যায়নি, আজ কর্তাগিন্নির যৌথবচনে তা শুনতে পেলেন ডঃ দাশগুপ্ত। অন্বয় নাকি বিগত কয়েকদিন ধরে অদ্ভুত কিছু কথা বলছে যার মানে বুঝতে পারছে না স্বরলিপি। অচেনা কোনও এক ভাইরাসের আক্রমণে অনেক মানুষের মৃত্যুর বর্ণনা দিচ্ছে সে। অনেকটা ইতিহাসে-পড়া মহামারীর মত। ছেলেবেলায় সে যে শহরে থাকত সেই শহর নাকি একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। শেষদিকে ক্রিমেশনেরও তেমন সুযোগ ছিল না। রাস্তায় মৃতদেহের ঢল নেমেছিল। সে নিজেও প্রায় মরতে বসেছিল ওই রোগের কবলে। স্লিপ-মেজারিং অ্যাপে ইদানীং অন্বয়ের স্লিপিং প্যাটার্নেও রীতিমত ডিস্টার্বেন্স ধরা পড়ছে। মুখোশে ঢাকা মানুষের সারি আনাগোনা করছে তার স্বপ্নে। স্বরলিপি রীতিমত চিন্তিত। যাওয়ার আগে একান্তে ডেকে কথা বলার সময় তার মুখেচোখে উদ্বেগের চিহ্ন গোপন ছিল না।
ঘুমের মধ্যেও কীসব শব্দ বিড়বিড় করে, জানেন?
যেমন?
আইসোলেশন… কো-মর্বিড… লকডাউন…আরও কীসব যেন…ডঃ দাশগুপ্ত, ইজ হি হ্যালুসিনেটিং থিংস?
এখনই সেটা বলা মুশকিল, স্বরলিপি।
স্কিৎজোফ্রেনিক কোনও সিম্পটম নয় তো এগুলো? হি হ্যাজ ফ্যামিলি হিস্ট্রি অফ…
আহা, ডাক্তারিটা আমার ওপরেই ছেড়ে দিন না! অ্যান্ড ডোন্ট ওভারথিংক।
আচ্ছা, সেই যে আগেকার দিনে কীসব বলত, জাতিস্মর-টর, ওরকম কোনও ব্যাপার নয়, বলুন!
হা হা! এইবার হাসালেন ম্যাডাম। এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ইট মে বি আ সিম্পল কেস অব এক্সেসিভ স্ট্রেস। আমায় দয়া করে একটু ভাবার সময় দিন।

স্বরলিপির কাছে বিষয়টা যথাসম্ভব হালকা করতে চাইলেও ডঃ দাশগুপ্ত নিজেও যে ভাবছেন না, এমন নয়। অন্বয়ের কথাগুলোয় কীসের যেন একটা ছেঁড়া সূত্র দেখতে পাচ্ছেন তিনি, মনে হচ্ছে শুধু জোড়া লাগানোর অপেক্ষা। মহামারী… প্যানডেমিক… অনেক লোকের মৃত্যু… কোথায় যেন, কবে যেন… কোনও বইয়ে পড়েছিলেন কি?
নিমেষে বিদ্যুৎ খেলে যায় দাশগুপ্তের মস্তিষ্কে। দ্রুতহাতে পকেটে রাখা ই-প্যাড হাতড়ে স্টাডি ট্যাবে হাত ছোঁয়ান তিনি। ব্যালকনি লাগোয়া বেডরুম স্টাডিরুমের চেহারা নিতে না নিতেই হিস্ট্রি সেকশনের দিকে এগিয়ে যান। ভয়েস-ইন্সট্রাকশনে গম্ভীর গলায় বলেন “টু জিরো টু জিরো প্লিজ…”

গোধূলির আকাশ থেকে কমলা রোদের আভা ধীরে ধীরে মুছে গিয়ে ধূসর কোমলতায় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। এইসময়ে চেম্বারের জানলার পর্দা সরানোই থাকে। ছিমছাম ঘরটির সুদৃশ্য অন্দরে বাইরের ক্ষীণ আলো এখনও কিছুটা এসে পড়ছে বলে আলো জ্বালানোর প্রয়োজন অনুভব করছেন না দাশগুপ্ত। তাছাড়া চেম্বারে তাঁর টেবিলের উল্টোদিকে যিনি বসে আছেন, বছর দশেকের চেনাশোনার পর তাঁর সামনে ফর্মালিটি তেমন মেইনটেইন না করলেও চলে।

সেই রাতটা দাশগুপ্তের হিস্ট্রি সেকশনেই কেটেছিল, শুতে যাওয়ার আর অবকাশ পাননি। বিস্তর বইপত্র ঘাঁটার পর বুঝতে পারেন, অন্বয়ের কথায় কোনও ভুল নেই। মহামারী একটা সত্যিই হয়েছিল। পৃথিবীব্যাপী মহামারী। অন্বয়ের বয়েস তখন সতেরো আঠেরোর কাছাকাছি। এরপর দুহাজার একান্ন সালে জীববিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কার টেরামাইসিন পৃথিবী থেকে অধিকাংশ মারণ-রোগ নির্মূল করে দেয়। ফলে মানুষের গড় আয়ুও বেড়ে যায় বেশ খানিকটা। মনের রোগ-টোগগুলো অবশ্য থেকেই যায়। তার ফলেই ডঃ দাশগুপ্তের মত সাইকিয়াট্রিস্টরা করে-কম্মে খাচ্ছেন এখনো। আর ওই দু’হাজার পঞ্চাশ- বাহান্ন নাগাদই স্ট্রেসফুল আর ট্রমাটিক স্মৃতির ছাপ মানুষের মস্তিষ্ক থেকে চিরতরে দূর করার টেকনোলজি আবিষ্কৃত হয়েছিল। মানসিক-স্থিতি প্রায় হারাতে বসা গোটা মানবজাতির ওপর তা লার্জ স্কেলে প্রয়োগ করাও হয়েছিল। অন্বয়, স্বরলিপি বা দাশগুপ্তের মত অগণিত মানুষ তার সুফল ভোগ করছে আজ পর্যন্ত। আর ঠিক এই কারণেই উনিশ-কুড়িতে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর প্যানডেমিকের স্মৃতি হারিয়ে গেল অধিকাংশ মানুষের মন থেকে। রয়ে গেল কেবল গুটিকয় ইতিহাস বইয়ের পাতায়। ততদিনে ইতিহাসের চর্চাও অবশ্য বিলুপ্তপ্রায় সখে পর্যবসিত হয়েছে। পিছনের দিকে ফিরে চাওয়াকে হেরে যাওয়ার লক্ষণ বলে ভাবতে শিখেছে মানুষ।

সেজন্যই দাশগুপ্ত আর স্বরলিপির কাছে অন্বয়ের কথাগুলো দুর্বোধ্য ধাঁধার মত লেগেছিল। তাঁদের মস্তিষ্কে মহামারীর স্মৃতিরই যে অস্তিত্ব নেই! এসবের পরেও অবশ্য একটা ছোট্ট জট থেকে গেল। কোনও একটা অজ্ঞাত কারণে মুছে যাওয়া স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে অন্বয়ের মস্তিষ্কে… আর কারো তো তা হচ্ছে না!
কী সেই অজ্ঞাত কারণ? এই শেষ জটটুকু ছাড়াতেই আজ দাশগুপ্তের চেম্বারে ডাক পড়েছে অন্বয়ের। আজ অবশ্য তিনি সস্ত্রীক নন।

বলো হে ডাক্তার, আজ জরুরি তলব কীসের? তাও স্বরলিপিকে ডিলিট করে?
অন্বয়ের ভরাট কণ্ঠে সম্বিত ফিরে পান দাশগুপ্ত।
রসিকতা রেখে একটা জিনিস সিরিয়াসলি বলো দেখি, এই যে ডিসটার্বিং চিন্তাগুলো তোমার মাথার মধ্যে ডনবৈঠক দিচ্ছে, এর মধ্যে ভয় আর আতঙ্কের দৃশ্য ছাড়া আর কিছু আছে কি?
অর্থাৎ?
দেখো, এইক’দিনে স্বরলিপিকে যতটা ডিস্টার্বড লেগেছে, তোমাকে ততটা নয়। কারণটা খোলসা করো দেখি! শুধু খারাপ স্মৃতিই মনে পড়ছে, না আরও কিছু?
এতক্ষণে অন্বয়কে কিছুটা অন্যমনস্ক লাগে। আর খানিক যেন গম্ভীরও। অনেক দূরের কোনও দৃশ্যকে নির্ভুলভাবে যেন দেখার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।
প্যানডেমিক আসার আগে থেকেই আমি দীর্ঘদিন ঘরবন্দী হয়ে ছিলাম, জানো? কলেজের পড়াশুনা, চাপ অসহ্য লাগছিল। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করাও বন্ধ করে দিই। লোকের সঙ্গ বিভীষিকা মনে হত। একটা ভীষণ কঠিন কুচকুচে কালো দেয়াল আমায় আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলছিল।
তারপর?
কাউকে জানাইনি। মনে হত, বেঁচে থাকাটাই যখন অর্থহীন তখন আর সমাধান খুঁজে কী লাভ? আই ফেলট লাইক এণ্ডিং মাই লাইফ। তারপর মহামারী এল।আমার কাছে মৃত্যুর নতুন কোনও তাৎপর্য ছিল না। ফলে ভয় লাগেনি।
…দেন থিংস চেঞ্জড। বাবা ক্যান্সার পেশেন্ট ছিলেন। কেরিয়ার তৈরির ধাক্কায় তাঁর সঙ্গে কথা বলার ফুরসত তেমন একটা পাওয়া যেত না। রোগের ভয়ে সবাই যখন ঘরবন্দী, দেখলাম, শুধু আমার উপস্থিতিটাই একটা লোকের কাছে কতটা ইম্পরট্যান্ট হতে পারে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রোগের যন্ত্রণা সত্ত্বেও তাঁকে হাসিখুশি দেখেছি। ইন দ্য মিনটাইম…
কী হল?
শি কলড মি।
কে?
খুব ছোটবেলা থেকেই, জানো, ইচ্ছে ছিল কবিতা লিখবো। ভালো ছাত্র হিসেবে, তাও ফিজিক্সের মত জাঁদরেল বিষয়ের… একবার দুর্নাম রটে গেলে ওইসব ফালতু বিষয়ে আর সময় দেওয়া যায় না। উচ্চাশার চূড়াকে ধাওয়া করতে গেলাম। এখন ওসব ইতিহাস… কিন্তু ভাই, নিজে রোগে পড়ার আগে পর্যন্ত চুটিয়ে কিছু কবিতা লিখেছিলাম বটে। কেমন হয়েছিল জানি না, তবে ওকে ইম্প্রেসড করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
এবার প্রায়ান্ধকার চেম্বার দুই বন্ধুর অট্টহাসিতে ভরে ওঠে।
এখনও তুমি বলবে এগুলো আমার মনের মাধুরী মিশিয়ে বানানো? আমি হ্যালুসিনেট করছি?
উঁহু!
তাহলে কী করণীয়, ব্রাদার?
ভালো স্মৃতিগুলোর দিকে কনসেনট্রেট করো । কিচ্ছু হয়নি তোমার।একটা মাইল্ড ট্রাঙ্কুইলাইজার দিচ্ছি, ব্যস!
যাক, … আর ইয়ে… এই ফোনের কেসটা…
ডোন্ট ওরি! প্রফেশনাল সিক্রেট।

সেদিন অন্বয় চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন দাশগুপ্ত। স্মৃতি অতি আজব বস্তু! মানুষের দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতির সঙ্গে সচরাচর ভালো বা মন্দ কোনও জোরালো অনুভূতির যোগ থাকে। অন্বয়ের মস্তিষ্ক থেকে মহামারীর স্ট্রেসফুল ইভেন্টগুলো ওয়াইপ আউট করা গেলেও ওর আতঙ্কের অভিজ্ঞতায় সুখস্মৃতির সহাবস্থান ছিল। সেটাকে স্বাভাবিক কারণেই ইরেজ করা যায়নি। আর তারই অনুষঙ্গে আজ একটা আস্ত হারিয়ে যাওয়া সময় উঠে আসছে ওর স্মৃতিতে। তা আসুক। দাশগুপ্তের মনে আর কোনও অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে নেই। মুখে তাঁর মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ে। কর্টিসলের চেয়ে ডোপামিনই বোধহয় বেশি শক্তিশালী, মহামারীর চেয়ে ভালবাসা।

More From Author See More