দশ দিন আগে বিজু ফোন করেছিল। বলেছিল, ‘আমাদের সবাইকে এখান থেকে বের করে দিচ্ছে। বলছে ঘর পাঠিয়ে দেবে। গাড়িঘোড়া তো সব বন্ধ। কী করে অতটা রাস্তা যাব কে জানে? যাই হোক শোন, পথেঘাটে ফোন চার্জ দিতে পারব না। একেবারে গিয়ে দেখা হবে।’
আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল টুম্পা। কপালে হাত ঠেকিয়ে বলেছিল, ‘জয় বাবা করোনা।’
লোকে এই ভাইরাসটাকে গালমন্দ করছে ঠিকই, তা ভাইরাস মাইরাস তো গালমন্দ করারই জিনিস। শুরুর দিকে টুম্পাও করেছিল। বস্তি থেকে বেরিয়ে অটোয় সাত টাকা ভাড়া দিলেই আলিশান হাউজিং কমপ্লেক্স। ওখানেই তিনটে বাড়িতে কাজ করে টুম্পা। এক দিন সকালে ঢুকতে যাবে আটকে দিল সিকিউরিটি গার্ড, ‘তোদের ভেতরে ঢোকা বারণ।’
‘মানে? কেন?’, অবাক হয়েছিল টুম্পা।
‘খবরটবর কিছুই দেখিস না না কি? আরে সবার এখন ভাইরাস হচ্ছে। করোনা ভাইরাস। হেব্বি ছোঁয়াচে। তাই বাইরের লোকেদের ভেতরে ঢোকা বারণ।’
‘কী আলফাল বকছ?’
‘আরে আলফাল না। একে বলে লকডাউন। যদ্দিন না লকডাউন উঠবে সব বন্ধ।’
‘বন্ধ থাকলে কাজ করব কী করে? আর কাজ না করলে খাব কী? এমন হুট করে বন্ধ করে দিলেই হল?’
‘সে আমি কী জানি? যা যা বাড়ি যা। সাবধানে থাক। বাড়ি থেকে বেরবি না বুঝেছিস? আর বেরোলেও নাকেমুখে কাপড় চাপা দিবি।’
আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ৩
সিকিউরিটি গার্ডের ঘর থেকেই তিনটে ফ্ল্যাটে ফোন করেছিল টুম্পা। সবাই ইনিয়েবিনিয়ে একই কথা বলেছিল যার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, লকডাউনে সবাই এত ভয় পেয়েছে যে মাসের মাইনেটা কবে দিতে পারবে এখনই বলতে পারছে না।
খিস্তি করতে করতে বেরিয়ে এসেছিল টুম্পা। যাদের বাড়িতে কাজ করে তাদের তো বটেই আর একই সঙ্গে এই ঢ্যামনা ভাইরাসটাকে। নতুন মোবাইল ফোন কিনবে বলে একটু টাকা জমিয়েছিল, এখন সেই টাকায় হাত পড়বে। কিন্তু সেই ভাইরাসকে গালমন্দ করা টুম্পাও নেচে উঠেছিল বিজুর ফোন পেয়ে। মনে মনে বলেছিল, ‘লোকে যতটা বাড়াবাড়ি করছে ভাইরাস ব্যাপারটা মোটেও ততটা খারাপ নয়।’ আসলে বিজু বাড়ি ফিরছে এর থেকে ভাল খবর আর কী হতে পারে?
তবে এ বার বেশ চিন্তা হচ্ছে টুম্পার। সেই যে ফোন এসেছিল তার পর আজ এগারো নম্বর দিন। এখনও বিজু এসে পৌঁছল না। অনেক বার ফোন করেছে টুম্পা কিন্তু প্রত্যেক বারই ফোন বন্ধ পেয়েছে। এ বস্তির আরও ছ’জন বিজুর সঙ্গেই গেছিল। তাদের বাড়িতেও খোঁজ নিয়েছে টুম্পা কিন্তু সেখানেও কেউ কিছু বলতে পারেনি। গত দশ ধরে তারাও চিন্তায় আছে।
আজ রোদের তাত কম। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে রিস্কাটার ওপর বসল টুম্পা। বিজু আসবে খবর পেয়েই রিস্কাটাকে সে একেবারে ঘরের সামনে এনে রেখে দিয়েছে। একদম নতুন রিস্কা। গা থেকে রঙের গন্ধ ওঠেনি এখনও। হ্যান্ডেলটায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে প্লাস্টিকের জবার মালা লাগানো। হুড থেকে আবার একটা সালমান খানের ছবি ঝুলিয়ে দিয়েছে টুম্পা। ভাইজান ওর আর বিজুর দু’জনেরই ফেভারিট। উফ! রিস্কাটা দেখলে বিজু যা চমকে যাবে না, ভাবতেই এই চিন্তার মধ্যেও হাসি ফুটে ওঠে টুম্পার মুখে। আলতো করে সে হাত বোলায় রিস্কাটার গায়ে।
তিন বছর আগে দেনার দায়ে বিজুর রিস্কাটা বেচে দিতে হল। তখনই বিজু ঠিক করেছিল সোনার কাজ করতে বোম্বে চলে যাবে। এই বস্তিরই শ্যামল সোনার কাজ করে অনেক টাকা করেছে। ওই বলেছিল বিজুকে নিয়ে যাবে। বিজুর সাথে জুটে গেল আরও কয়েক জন। বিজুকে ট্রেনে তুলতে গেছিল টুম্পা। ট্রেন ছাড়ার আগে টুম্পা বিজুর হাত ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল, ‘যাস না। তুই যাস না। আমি বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার চালাব। বেশি টাকা আমাদের লাগবে না।’
টুম্পার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বিজু বলেছিল, ‘আরে আমি তো আসব মাঝে মাঝে। আর খানিকটা টাকা জমিয়ে একেবারে চলে আসব। এসে একটা রিস্কা কিনব। নতুন রিস্কার এখন অনেক দাম।’
‘আমি তোকে রিস্কা কিনে দেব। তুই যাস না।’
‘চুপ। আর আমি যেন না শুনি তুই লোকের বাড়ি কাজ করছিস। লোকের এঁটো বাসন মাজবি না বাল।’
‘তুই বাল।’
দরজায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ হাত নাড়িয়েছিল বিজু। টুম্পার এত কান্না পাচ্ছিল ও ভাল করে দেখতেই পাচ্ছিল না মানুষটাকে।
টুম্পা জানে, এক বার যে যায় সে সহজে ফেরে না। এই তিন বছরে মাত্র দু’বার ঘরে এসেছে বিজু। তবে হ্যাঁ প্রতি মাসে নিয়ম করে টাকা পাঠায়। ফোন করে। হোয়াটসাপে ভিডিও পাঠায় আর মাঝে মাঝে ভিডিও কল করে অনেক রাতে। টুম্পা তখন সব জামাকাপড় খুলে ফেলে। টুম্পার খুব ভাল লাগে। খুব কান্না পায়।
বিজুকে লুকিয়েই লোকের বাড়ি কাজ নিয়েছে টুম্পা। আর এই তিন বছরে টাকা জমিয়ে কিনে ফেলেছে একেবারে ঝকঝকে নতুন একটা রিস্কা। বিজুকে সারপ্রাইজ দেবে। টুম্পা সেভেন অবধি পড়েছে। সারপ্রাইজ সে ভালই দিতে জানে।
আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ২
আচমকা একটা হইহই কানে এল টুম্পার। লোকজন দৌড়াদৌড়ি করছে। রিস্কা থেকে নেমে সে ছুটে গেল বাইরের দিকে। কয়েক জন এদিকেই ছুটে আসছিল। তাদেরই এক জনকে ধরল টুম্পা, ‘কী হয়েছে রে বাবলু?’
‘বিজু, রমেশ ওরা সব ফিরে এসেছে।’
কথাটা হজম করতে সামান্য সময় নিল টুম্পা। তার পরই মুখে জ্বলে উঠল হাজার ওয়াটের ল্যাম্প, ‘কী বললি? ওরা ফিরে এসেছে?’
ছুটে যাচ্ছিল টুম্পা। বাবলু হাত টেনে ধরল, ‘আরে করছিস কী? যাস না। বাইরে পুলিশের গাড়ি এসেছে। হেবি ক্যালাচ্ছে। সবাইকে তাড়া দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। ওদের ওপর কী সব গ্যাস ছেটাবে বলছে। ভাইরাস মারা গ্যাস। তার পর ঢুকতে দেবে।’
চট করে ঘরে ঢুকে এল টুম্পা। আলমারি থেকে বার করল নতুন চুড়িদারটা। এত দিন পর মানুষটা আসছে। একটু না সাজলে চলে?
দুই…
বিজুর দেহটা শোয়ানো আছে বারান্দায়। মাথার বাঁ দিকটা ফেটে হাঁ হয়ে আছে। সমানে রক্ত গড়াচ্ছে সেখান থেকে। ভিড় জমে গেছে লোকজনের। অনেক জল ছিটিয়েছে টুম্পা কিন্তু বিজুর জ্ঞান ফেরেনি। খুব আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রমেশ মাথা নিচু করে বলল, ‘পুলিশ মেরেছে। গোটা রাস্তা আমাদের হাঁটিয়ে এনেছে আর মাঝে মাঝেই গায়ে কী সব ছিটিয়ে দিচ্ছিল। খুব ঝাঁঝালো গন্ধ। গায়ে পড়লেই চিড়বিড় করে ওঠে। ওতে না কি ভাইরাস মরে যায়। এখানেও ঢোকার আগে বলল ছেটাবে। আরে চোখ বুজতে তো দেবে তার আগেই ছিটিয়ে দিয়েছে। বিজুর চোখে গিয়ে পড়েছিল। চোখের জ্বালায় ও লাফিয়ে উঠেছিল আর পুলিশ ভেবেছে ও পালাচ্ছে। তিন জন মিলে পিটিয়ে দিয়েছে।’
চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল টুম্পা, ‘ওরে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে। কে যাবে আমার সাথে?’
মুহুর্তে দু’ পা পিছিয়ে গেল ভিড়টা। আঁতকে উঠে এক জন বলল, ‘পাগল হলি না কি? হাসপাতালে নিবি কী করে? গাড়িঘোড়া কিচ্ছু চলছে না। তা ছাড়া বাইরে পুলিশ খাপ পেতে দাঁড়িয়ে আছে। বেরলেই মারবে। আপাতত ডেটল দিয়ে ধুয়ে বোরোলিন গরম করে লাগা। বিকেলে ডাক্তারের খোঁজ করব।’
আর কথা বাড়াল না টুম্পা। ঘর থেকে দু’ খানা গামছা বার করে আনল।
অনেক দিন আগে টুম্পা একবার বায়না ধরেছিল, ‘আমাকে রিস্কা চালানো শিখিয়ে দিবি বিজুদা?’
আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ১
বিজু শিখিয়েছিল। কাঁপা হাতে রিস্কা চালাচ্ছিল টুম্পা আর পেছনে বসে বিজু চেঁচাচ্ছিল, ‘পড়ে যাব। পড়ে যাব। তুই আমাকে ফেলে দিবি।’
আজ বিজুর অচেতন দেহটা রিস্কার সিটের সাথে গামছা দিয়ে কষে বাঁধতে বাঁধতে টুম্পা ফিসফিস করে বলল, ‘ভয় নেই। তোকে ফেলে দেব না।’
তিন…
বাইরে দাঁড়িয়েছিল চারটে পুলিশের গাড়ি। একটু আগেই একটা হাঙ্গামা হয়ে গেছে তাই আরও বেশি করে ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে বস্তির সামনে। পুলিশরা নিজেদের মধ্যে কথা টুকটাক গপ্পোগাছা করছিল। দূর থেকে একটা রিক্সা আসতে দেখে চমকে উঠল তারা। আরও অবাক হল যখন দেখল রিক্সা চালাচ্ছে একটা মেয়ে। হইহই করে এগিয়ে গেল পুলিশেরা, ‘এই দাঁড়া। দাঁড়া। কোথায় যাচ্ছিস?’
রিক্সা থেকে নামল না টুম্পা। প্যাডেলে পা রেখেই এক জন পুলিশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্বামীকে নিয়ে হাসপাতাল যাচ্ছি। ওরে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে আনি তার পর যারা ওর এই দশা করেছ তাদের খবর নেব। খাতায় লিখে রাখতে পারো, আমার নাম টুম্পা। ও আমার বর। বিজু।’
প্যাডেলে চাপ দিল টুম্পা। পুলিশেরা কিচ্ছু করতে পারল না। তারা শুধু অসহায় হয়ে দেখল, রোদ্দুর ধোয়া ফাঁকা রাস্তা দিয়ে একটা মেয়ে রিক্সা চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সিটে গামছা দিয়ে বাঁধা তার রক্তাক্ত বর আর রিক্সার পেছন থেকে হাসি মুখে হাত নাড়ছেন ভাইজান।
কী আর করা যাবে? ভালবাসা যখন পথে নামে তখন সে রাষ্ট্র বা ভাইরাস কারোরই পরোয়া করে না।