রাজেনবাবু মোবাইল ফোনে খবর পড়ছিলেন। এখন খবরের কাগজ নেওয়া যাচ্ছে না তাই মোবাইল ফোনেই কাজ চালাতে হচ্ছে। বেশির ভাগ লোকেই খবরের হেডলাইনটুকু দেখে পরের খবরে চলে যায়। পুরো খবরটা পড়ে না। রাজেনবাবু সেই দলে নন। তিনি খবরের প্রত্যেকটি শব্দ মন দিয়ে পড়েন। খবরের ভেতরেও খবর থাকে, সেইটে ছেঁকে নিতে হয়। তিনি মনে করেন, সব মানুষের আপ-টু-ডেট থাকা উচিত আর সেটা থাকতে গেলে মন দিয়ে খবর পড়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। কিন্তু অনেক বলেও রাজেনবাবু তাঁর স্ত্রী পাপিয়াকে খবর পড়ানোর অভ্যেস ধরাতে পারেননি।
পাপিয়ার নেশা সিরিয়ালে। সে রোজ সন্ধে ছ'টা থেকে রাত এগারোটা অবধি সিরিয়াল দেখে। দেখতে দেখতে কখনও হাসে, কখনও কাঁদে, কখনও আবার বিড়বিড় করে। গা পিত্তি জ্বলে যায় রাজেনবাবুর। তাঁর মতে, সিরিয়াল মাত্রই বস্তাপচা। তার ওপর এখন যেহেতু লকডাউন চলছে তাই দু'-তিন বছর আগে পচে যাওয়া বস্তাগুলো চ্যানেলে দেখাচ্ছে। পুরনো সিরিয়ালগুলো পাপিয়ার নখদর্পণে। একটা সিন শেষ হতে না হতে সে বলে দিচ্ছে পরের সিনে কী দেখাবে আর মিলে গেলেই কাজের মেয়ে টুসিকে ধাক্কা মেরে মেরে বলছে, দেখলি কেমন মিলিয়ে দিলাম?
শেষকালে আর থাকতে না পেরে পরশুদিন রাজেনবাবু পাপিয়াকে বলেছিলেন, ও সব ছাইপাঁশ না দেখে একটু বইটই পড়লে তো পারো।
পাপিয়া অবাক হয়ে বলেছিল, বই পড়ব কেন? আমার কী সামনে পরীক্ষা? কী যে আবোলতাবোল বকো না তুমি!
এর পর আর কথা চলে না। রাজেনবাবু স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন। আজ খবর পড়তে পড়তে তিনি শুনতে পেলেন রান্নাঘরে পাপিয়া টুসির সঙ্গে কী একটা সিরিয়ালের গল্প করছে। তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। পনেরো মিনিট আগে চা চেয়েছেন। সে চা যে কখন পাওয়া যাবে ঠিক নেই।
আজকাল প্রায়শই পাপিয়াকে অসহ্য লাগে রাজেনবাবুর৷ লকডাউনের পর থেকে ব্যাপারটা আরও বেড়েছে। মাঝেমাঝেই মনে হয় চড় মেরে পাপিয়ার কানের পর্দা ফাটিয়ে দেন। কিন্তু মেয়েমানুষের গায়ে হাত তোলা বিরাট ঝকমারি। তাই ইচ্ছে থাকলেও চোখ লাল করেই চেপে যেতে হয়। তা তাঁর লাল চোখকে যে পাপিয়া ভয় খায় এমনটা নয় বরং তিনি মেজাজ দেখালে সে গা মুচড়ে মুচড়ে হাসে।
আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ২
পাপিয়ার মধ্যে একটা খুকি খুকি ব্যাপার আছে। বিয়ের দশ বছর হয়ে গেলেও এখনও বাচ্চা হয়নি। রাজেনবাবু কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। একটা সময় স্ট্যামিনা বাড়ানোর জন্য রোজ দু'বেলা ছোলা আর বাদাম খেতেন৷ জিমেও গেছেন কয়েক মাস। তা ছাড়া কবিরাজি ওষুধও খেয়ে দেখেছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু লাভ হয়নি। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেছে, দু' জনেরই কোনও সমস্যা নেই। তবু বাচ্চা হচ্ছে না। এই নিয়ে মরমে মরে থাকেন রাজেনবাবু। পাপিয়া কিন্তু নির্বিকার। তার যেন কোনও মাথা ব্যথা নেই। এটাই রাজেনবাবুকে সবচেয়ে বিরক্ত করে। ভেবেছিলেন এই লকডাউনের বাজারে একটু চেষ্টা করে দেখবেন। কিন্তু পাপিয়া গায়েই মাখছে না। কাছে গেলেই হাই তুলছে। ধুর ধুর। কাঁহাতক আর বাড়ি বসে থাকতে ভাল লাগে? তাই পাড়ার ছেলেদের দলে নাম লিখিয়েছেন। ওরা বস্তিতে বস্তিতে খাবার বিলি করে। রোজ দুপুরে আর রাতে সেখানেই যান তিনি। ক্লাবের মাঠে রান্না হয়। মোবাইলটা বন্ধ করলেন। রান্না কদ্দূর একটু তদারক করে আসা যাক।
চেয়ারে বসেই সবে মাস্কটা হাতে নিয়েছেন,
টিয়া পাখি মিঠু বলে উঠল, কী রঙের প্যান্টি পরেছিস টুসি?
রাজেনবাবুর হাতের মাস্ক হাতেই রয়ে গেল। তাঁর চোখের সামনে যেন পৃথিবীটা দুলে উঠল। তিনি বুঝলেন, হু হু করে তাঁর ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। দরদর করে ঘামতে ঘামতে কোনও মতে চেয়ারের হাতলটা খামচে ধরে বিস্ফারিত চোখে তিনি মিঠুর দিকে তাকালেন আর তখনই মিঠু বলল, বাহ! বেশ বানিয়েছিস তো টুসি।
লাফ মেরে উঠে দাঁড়ালেন রাজেনবাবু। কেউ শুনে ফেলার আগেই পাখিটাকে নিকেশ করতে হবে। পাখিটা ভয়াবহ সব কথা বলতে শুরু করেছে। খাঁচার দরজা খুলে তিনি মিঠুর গলা চেপে ধরতে গেলেন। বুড়ো আঙুলের ওপর জব্বর এক ঠোকর বসিয়ে দিল বজ্জাত পাখিটা। রাজেনবাবু বললেন, উফ! মা গো।
মিঠু বলল, আস্তে টুসি। তোর বৌদি শুনতে পাবে।
আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ১
যে দিন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন তিন দিন পর থেকে গোটা দেশে লকডাউন ঠিক তার পরের দিন তাঁদের ভাড়াটে সুনয়ন এসে বলেছিল, রাজেনদা, এই লকডাউনে ভাবছি বউকে নিয়ে মা-বাবার কাছে বর্ধমান চলে যাব। তা মায়ের আবার পশুপাখিতে অ্যলার্জি। তাই ভাবছিলাম, আমাদের মিঠুকে আপনাদের কাছে রেখে যাব। ও খুব ভাল পাখি। কোনও ঝামেলা করবে না। আপনার আপত্তি আছে?
নীচের তলায় সুনয়ন আর তার বৌ ভাড়া থাকে। যাতায়াতের পথে দেখেছেন পাখিটা বারান্দায় খাঁচায় ঝোলানো থাকে। পাখিটা মজার। বেশ টরটর করে কথা বলে। পাপিয়া মাঝেমাঝেই গিয়ে পাখিটাকে কথা বলার জন্য খোঁচায়। রাজেনবাবু বলেছিলেন, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তোমার বৌদিকে না জিগ্যেস করে তো…
চায়ের কাপ হাতে পাপিয়া ঢুকে এসেছিল ঘরে। কথার মাঝখানেই বলেছিল, আমার আবার আপত্তি কী? মিঠু তো আমার সোনা।
সেই থেকে মিঠুসোনা রাজেনবাবুর বসার ঘরে দোল খাচ্ছে। প্রথম দিন দুয়েক পাখিটা মুষড়ে ছিল কিন্তু তার পর থেকেই ফর্মে চলে এসেছিল। রাজেনবাবু লক্ষ্য করেছিলেন, নতুন কথা খুব দ্রুত তুলে নিতে পারে মিঠু। এখন তো সে মাঝেমাঝেই পরিষ্কার উচ্চারণে বলে, পাপিয়া চা দাও, টুসি শুনে যা বা রাতে ভাত না রুটি ইত্যাদি। কিন্তু মিঠু যে এ সব কথা বলে বসবে তা রাজেনবাবু দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি।
টুসি তাঁদের ২৪ ঘণ্টার কাজের লোক। এখানেই থাকে। মাসে, দু'মাসে এক বার দেশের বাড়ি যায়। তা লকডাউনে যে টুসি এখানেই থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আর টুসি আছে বলেই এই লকডাউনে রাজেনবাবু বেঁচে আছেন। নয়তো কবে পাগল হয়ে যেতেন। কিন্তু এখন তিনি কী করবেন? ভাগ্যিস মিঠু কথাগুলো পাপিয়ার সামনে বলেনি। তবে এখন বলেনি মানে ভবিষ্যতে যে বলবে না তার তো কোনও গ্যারান্টি নেই। পাপিয়া জানলে যে কী করবে সেটা ভাবতে গিয়েই রাজেনবাবু বুঝতে পারলেন তাঁর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে স্ট্রোক হয়ে যাবে।
ক্লাবে না গিয়ে মিঠুর খাঁচাটা নিয়ে বাগানে বসে আছেন রাজেনবাবু। মিঠুর খাবারে তিনি ইঁদুরমারা বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন। মধুমাখা গলায় তিনি বললেন, খাও মিঠুমা, লঙ্কাটা খাও। দেখো কী সুন্দর টুকটুকে লাল লঙ্কা।
উত্তরে মিঠু গম্ভীর গলায় বলল, তোর বৌদিকে বলিস না টুসি।
নাওয়া খাওয়া ভুলে বিকেল পর্যন্ত খাঁচার সামনে বসে রইলেন রাজেনবাবু। কিন্তু কী করে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ভেবে পেলেন না। পাখিটা বিরাট চালাক। লঙ্কাটা খায়নি। খাঁচার দরজা খোলা, উড়েও যায়নি। ভেতরেই গ্যাঁট হয়ে বসে রয়েছে। রাজেনবাবু এক বার ভেবেছিলেন লঙ্কাটা নিজেই খেয়ে নেবেন কিন্তু অতি কষ্টে নিজেকে সামলেছেন। তাঁকে এ ভাবে বসে থাকতে দেখে অনেকক্ষণ ধরেই পাপিয়া আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। তার চোখে রাজ্যের প্রশ্ন। নাহ! এ ভাবে আর বসে থাকা যাবে না। শেষমেশ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন রাজেনবাবু।
পাপিয়া সিরিয়াল দেখছিল। গলাটা ঝেড়ে রাজেনবাবু বললেন, সাউন্ড কমাও। কথা আছে।
সাউন্ড না কমিয়েই পাপিয়া বলল, কী কথা?
আসলে আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি।
এ বার টিভি বন্ধ করে ঘুরে বসল পাপিয়া, মানে?
মানে আমি দু'-এক বার টুসির সঙ্গে… মানে ইয়ে আর কী… অ্যাক্সিডেন্ট বুঝলে তো… লকডাউনে মাথার ঠিক ছিল না… আর হবে না কথা দিচ্ছি। তুমি কি টুসিকে ছাড়িয়ে দিতে চাও?
প্রথমে কিছুক্ষণ গোলগোল চোখে তাকিয়ে রইল পাপিয়া। তার পর হু হু করে কেঁদে উঠল, তুমি কি না কাজের মেয়ের সঙ্গে! ছি ছি ছি! বিশ্বাসঘাতক।
বড় অসহায় বোধ করলেন রাজেনবাবু। মনে হল মিঠুর ঘাড়টা মুচড়ে ভেঙে দেন। ঠিক তখনই মিঠু পরপর দু'টো কথা বলে উঠল,
এক. পরিদা, জোরে জোরে।
দুই. আমার বর তো ছাগল। এক মিনিটে ফুস।
রাজেনবাবু বললেন, পরিদা মানে কি ক্লাবের সেক্রেটারি পরিমল? আর বাই এনি চান্স এই ছাগলা বরটা কি আমি? আচ্ছা বুঝেছি, এই জন্য পরিমল দুপুরবেলা খাবার বিলি করার সময় থাকে না।
এ বারে পাপিয়া ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল। নিজের গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মারলেন রাজেনবাবু। চমকে উঠল পাপিয়া আর সেই সুযোগে তার গালেও পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিলেন রাজেনবাবু। যাক, চড়ে চড়ে কাটাকাটি।
পরের দিনই মাস্ক পরে বাজারে গিয়ে প্রদীপ গোলদারকে পাখিটা গছিয়ে দিলেন রাজেনবাবু।
দিন সাতেক পর। সন্ধেবেলা পাপিয়া আর রাজেনবাবু গল্প করতে করতে মুড়ি খাচ্ছেন আর খুব হাসাহাসি করছেন, প্রদীপ গোলদারের ফোন এল, রাজেন, পাখিটা নিয়ে যাও ভাই। বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে।
নির্বিকার মুখে ফোন কেটে দিলেন রাজেনবাবু। একই ভুল তিনি আর করবেন না। এ ধরনের টিয়া বাড়িতে না ঢোকানোই ভাল।