লকডাউনের গপ্পো ১৪

- স্যার! ব্যস্ত?

- এ কী! পুলিশ! এখানে!

- না না। পুলিশের ইউনিফর্ম পরলেই পুলিশ নাকি?

- তাহলে তুমি কে? এখানে ঢুকলে কী করে?

- আমাকে আপনি চিনবেন না স্যার। আমি কাছেই থাকি। সতীন সেন কলোনি।

- আশ্চর্য! ঢুকলে কী করে এখানে?

- গেট দিয়েই ঢুকেছি। অত বড় গেট থাকতে আর কোথা দিয়ে ঢুকব?

- লোকনাথ! লোকনাথ!

- লোকনাথ মানে কি আপনার ওই মুসকো সিকিউরিটি গার্ডটা? ডেকে লাভ নেই। ঘুমোচ্ছে।

- ঘুমোচ্ছে মানে?

- হাই ডোজের ক্লোরোফর্ম।

- হারাধনদা’! রঘু!

- কাউকেই ডেকে লাভ নেই। বাড়িশুদ্ধু সব্বাই ঘুমোচ্ছে। উঁহু উঁহু, নড়বেন না। হাতে এটা দেখছেন? খুলি চচ্চড়ি হয়ে যাবে।   

- কী মতলব বলো তো তোমার?

- ছোট্ট একটা কাজ আছে। টুক করে সেরে চলে যাব। হাতে সময় কম তাই টিকরমবাজি না করে চুপচাপ যা বলব তাই করবেন।

- তুমি ধমকি দিচ্ছ আমাকে? জানো না আমি কে? আমার কত পাওয়ার?

- জানব না? বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে প্রচণ্ড ভয় পাই। ওরা যখন বলল কাজটা আমাকেই করতে হবে, আমার ফেটে হাতে চলে এসছিল। কিন্তু কী জানেন, দেওয়ালে পিঠ থেকে গেলে সব ভয়ডর চলে যায়। আপনার বেডরুম অবধি পৌঁছাতে কত পাঁপড় বেলতে হয়েছে জানেন? পুলিশকে ডিসট্র্যাক্ট করবে বলে নকল আনরেস্ট তৈরি করতে হয়েছে। উফফ সে এক কাণ্ড! নন্দননগর মোড়ের দিকে গেলে এখনও দেখতে পাবেন তিন চারটে লোক করোনা অ্যাফেক্টেড সেজে মাঝরাস্তায় চূড়ান্ত বাওয়াল দিচ্ছে। গোটা বেলঘরিয়া পুলিশ ষ্টেশন সেই নিয়ে ব্যস্ত। আর সেই ফাঁকে আমরা আরামসে আপনার বাড়ি ক্যাপচার করে নিয়েছি।

- আমরা মানে?

- আমার সাথে আরও লোকজন আছে। একা একা কি এসব কাজ হয়?

- কী চাও?

- খুব সামান্য দাবি। আপনার সাধ্যের মধ্যেই। যে কয়েকশো কেজি চাল ডাল আলু আপনি আপনার বাড়িতে মজুত করে রেখেছেন সেগুলো বের করে দিতে হবে।

- এসব ফালতু কথা কে বলল তোমাদের?

- সবাই জানে। মানুষকে ত্রাণ দেবার নামে এলাকার সমস্ত দোকানদারদের থেকে প্রতি সপ্তাহে তোলা তুলছেন। তার মধ্যে কিছুটা দিচ্ছেন। বাকি জিনিসগুলো যাচ্ছে কোথায়?  

- একদম এসব ফালতু কথা বলবে না। যা কালেক্ট করেছি সবটাই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তোলা তুলছি মানে? মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ।

- তোলাই তো। এদিকে ডানলপ থেকে ওদিকে বেলঘরিয়া ষ্টেশন, তিন কিলোমিটার রেডিয়াস জুড়ে প্রত্যেকটা বাজার থেকে গত দেড় সপ্তাহে সব মিলিয়ে প্রায় আটশো- নশো কেজি চাল, চারশো কেজির কাছাকাছি মুসুরির ডাল, আর সাড়ে সাতশো কেজি আলু তুলেছে আপনার লোকজন। একটা নয়া পয়সাও ঠেকাননি।  এবার তারা দোকান বন্ধ করে দিলে লোকে যাবে কোথায়?

- যা বলছ প্রমাণ করতে পারবে তো?

- কী করে প্রমাণ করব? দোকানদাররা কেউ স্বীকার করবে নাকি? কিন্তু আমার তো প্রমাণ করার দায় নেই। আমি তো আপনাকে চার্জশিট দিচ্ছি না। যাকগে, সেটা আলাদা ইস্যু। আমি যেটা বলতে এসেছি সেটা হচ্ছে যা তুলেছেন সবটা তো দিচ্ছেন না। বাকিগুলোর কী হচ্ছে সেটাই জানতে চাই।

- প্রায় সাড়ে চারশো ফ্যামিলির হাতে আমরা খাবার তুলে দিয়েছি। কত জিনিস লেগেছে জানো? তোমার ঝাঁটে অত চুল নেই যত কেজি খাবার আমরা বিলি করেছি। শুয়ার!

- সাড়ে চারশো? আচ্ছা বেশ। আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, বলছেন, তাও না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু আরও একটা হিসেব যে গোলমাল স্যার। টিভিতে শুনলাম আপনারা বলছেন প্রত্যেক প্যাকেটে নাকি দু’ কেজি চাল, দু’ কেজি আলু, পাঁচশো ডাল, পাঁচশো সোয়াবিন আছে। তাহলে তো মোট পাঁচ কেজি ওজন হবার কথা। কিন্তু  অনেকগুলো প্যাকেট আমরা নিজেরা মেপে দেখেছি। আমাদের কলোনিতেও তো দিয়েছেন আপনারা। ওজন করে দেখেছি এক একটা প্যাকেট সাড়ে চার বা চার কেজি ছশোর বেশি হচ্ছে না। সেখান থেকেও মারছেন। ছ্যাঁচড়ামির একটা সীমা থাকা উচিত বলে মনে হয়না আপনার?

- মুখে মাস্ক দিয়ে ভেবো না বেঁচে যাবে। তোমার চোখ আমি দেখে নিয়েছি। তোমাকে খুঁজে বার করতে আমার কয়েক সেকেন্ড লাগবে। তারপর তোমার বাবার নাম নেত্যকালী না করেছি তো আমার নাম সনাতন বিশ্বাস নয়।

- আচ্ছা বেশ। আগে তো উঠুন। আমাদের কাছে খবর আছে লোকের মারা চাল ডাল সব আপনার গ্যারাজে স্টোর করা আছে। উঠুন। গ্যারাজ খুলুন। আমরা ওগুলো নিয়ে যাব।  

- এত খবর তোমাদের কে দিল বলো তো? এই বাড়িতে ঢুকে পড়াও তো যার তার কম্মো নয়। কে হেল্প করছে তোমাদের? লোকনাথ না নিশ্চয়ই। লোকনাথ কুকুরের মতো বিশ্বাসী।  

- ঠিক ধরেছেন। আমাদের মাথায় খুব মহান একজনের হাত আছে।

- অপোজিট লবির কেউ? বুবলা, তাই তো?

- ধুর। বুবলা ফুবলা না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

- সে আবার কে?

- আরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

- চ্যাংড়ামি হচ্ছে? মাজাকি মারছ আমার সঙ্গে?

- আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? বেশ। নিজের ভাইয়ের মুখ থেকে শুনলে বিশ্বাস করবেন তো? লালটু, এদিকে এসো তো গুরু। তোমার দাদা আমার কথা বিশ্বাস করছেন না।

- লালটু! তুই?

- ঠিকই দেখছ। আমিই।  

- তুইই তাহলে নাটের গুরু?

- আমি না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি তো নিমিত্ত মাত্র।

- মানে?

- ‘অসহযোগী’ গল্পটা মনে আছে তো দাদা? তুমিই আমার জন্মদিনে দিয়েছিলে বইটা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প। অনেকদিন পর পরশু ধুলো ঝেড়ে বইটা বের করলাম। গল্পটা পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হল, হোয়াই নট?   

- দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষলাম এতদিন?

- শাট আপ। জাস্ট শাট আপ। তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। তোমার কোনও ব্যাপারে আমি কোনওদিন কথা বলি না। এই যে তুমি পলিটিক্সের নামে গুন্ডারাজ চালাও, ক্ষমতার জোরে লোককে চমকে বেড়াও, তুমি তো জানো আমি এগুলো পছন্দ করি না? তবু কখনোই কিছু বলিনি। ভাবিওনি কখনও কিছু বলব। কিন্তু এরকম একটা ভয়ঙ্কর সময়ে মানুষের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে তুমি টাকা করবে, এটা তো আর হতে দিতে পারি না। গ্যারেজের চাবিটা দাও।

- না দিলে কী করবি?

- না দেবার প্রশ্নই উঠছে না। ওরা খেতে পাচ্ছে না, ওদের গ্যারাজ খুলে দিতেই হবে। চাবি কোথায় থাকে জানলে তোমায় বিন্দুমাত্র ডিস্টার্ব করতাম না বিশ্বাস করো। একেবারে সব ফর্সা হয়ে যাবার পর তুমি টের পেতে। উপায় নেই বলেই ডিস্টার্ব করতে বাধ্য হচ্ছি। চাবিটা দাও প্লিজ।

- না দিলে কী করবি বল? গুলি করবি আমায়? কর দেখি কেমন পারিস।

- সেটা পারব না তুমি ভালো করেই জানো। তাছাড়া গুলি টুলির মতো বোরিং ব্যাপারে কে যাবে, হোয়েন উই হ্যাভ আ ফার বেটার প্ল্যান? শোনো, আমার সঙ্গে ও ছাড়া আরও সাতজন আছে। সতীন সেন কলোনির সতেরোর পল্লীর ছেলে সব। এক ঘরে চার- পাঁচজন করে থাকে জানো তো? ভাইরাস সংক্রমণের জন্য একেবারে আদর্শ পরিবেশ। তুমি না উঠলে ওরা সবাই মিলে ঘরে ঢুকে তোমাকে ভালোবেসে জাপটে ধরে নামিয়ে নিয়ে যাবে।

- মানে? এটা কী ধরনের জানোয়ারপনা?

- এক্সট্রিমলি সরি। তবে চিন্তা কোরোনা। ওরা মাস্ক গ্লাভস সবই পরেছে। তুমি বাধা না দিলে বিপদের চান্স নেই। বাধা দিলে তবেই বডি কনট্যাক্ট, আর বডি কনট্যাক্ট মানেই রিস্ক। ফলে প্লিজ কো অপারেট। দীর্ঘশ্বাস ফেলো না। ওঠো।

- নিজের মায়ের পেটের ভাই, তুই যে এত বড় গাছহারামি টের পাইনি কোনওদিন।  

- লাভ ইউ টু। ওঠো ওঠো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।