-কি রে, ছুটি হল?
-হ্যাঁ। হোস্টেলে চলে এসেছি।
-ফোন করিসনি যে? অদ্ভুত তো! এমনিতে চিন্তায় মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়!
-আরে মানি হাইস্ট দেখছিলাম তো! এমন জায়গায় এক-একটা এপিসোড ছাড়ছে, থামতে পারছিলাম না।
-হুঃ! যাক গে, এ যাত্রায় ক্ষমা করলাম। তোকে এত ক্ষমা করতে হয় কেন কে জানে! আসলে মানি হাইস্ট শুনে একটা মজার কথা মনে পড়ল। শুনেছিস কি, অভিজিৎ বিনায়ক সাজেস্ট করেছেন যে, এই সময়ের অর্থনৈতিক ক্রাইসিসটা কাটাতে ইন্ডিয়া শুড প্রিন্ট মানি লিবারালি অ্যান্ড ট্রান্সফার ক্যাশ ডিরেক্টলি টু দ্য সেকশন অফ সোসাইটি দ্যাট নিড ইট মোস্ট। আর এটা শুনেই আমার কী মনে পড়তে পারে বুঝতেই পারছিস…
-দে আর প্রিন্টিং দেয়ার ওন নাম্বারলেস বিলস!! দেখ দেখ, এইজন্য কবে থেকে বলছি মানি হাইস্ট দেখ! কীরকম মিলিয়ে দিল দেখেছিস! আহ, আই লাভ নাইরোবি! শোন না, সিজন ফোরে নাইরোবির কী হল সে তো তুই জানিস না…
-থাম থাম, স্পয়লার দিবি না। বলেছিলাম যে এই হতভাগা করোনা বিদায় হোক, সিজন ফোর একসঙ্গে দেখব। তোর তো আর তর সইল না।
-তুই কবে আসতে পারবি তার ঠিক নেই, আমার তো বাড়ি যাওয়ার প্রশ্নই নেই, নাইরোবিকে অতদিন অপেক্ষা করানোটা কি ঠিক হত, বল!
-সিরিজ দেখে দেখেই জীবন কাটিয়ে ফেললি! কতবার বললাম, এই সময়টার ডকুমেন্টেশন রাখা খুব জরুরি। আর তোরা যারা ফ্রন্টে দাঁড়িয়ে লড়ছিস, তারা এটাকে কীভাবে দেখছিস, এই সময়ের রাজনীতিকে কীভাবে ফেস করছিস, সেটা লিখে রাখা খুব দরকার। ভাব তো, আজি হতে শতবর্ষ পরে হোথা কে পড়িছে বসে তোমার ডায়েরিখানি, কৌতূহলভরে!
-লিখছে তো অনেকেই। আমি বরং পড়ি।
-হুরিপরি-র দিকেই তোর নজর। নিদেনপক্ষে খানকতক কবিতাও তো নামাতে পারতিস এই লক ডাউনের বাজারে। প্রেমিকাকে পটানোর জন্যই তো কবিতার জন্ম। তোকে কিছুই করতে হল না, কেমন ঝড়ের মতো এসে পড়ল আর-একটা প্রেম!
-তা বটে! ভাইয়ের ডেঙ্গু হল, আর আমার প্রেম। ভাগ্যিস খোঁজ নিতে ফোনটা করেছিলি!
-তার আগে বল ভাগ্যিস নাটকটা করতে গেছিলাম! নয়তো ব্যাচমেট হয়েও তো কেউ কাউকে চিনতাম না।
-তাও কী নাটক, না, তাসের দেশ! কীরকম সমাপতন ঘটে না এক-একটা!
-তখনও কিছু ঘটেনি ভাই। তোর ডিউটি করেই জীবন যৌবন কেটে যাচ্ছিল, আর আমিও ডাক্তারদের বরাবর ‘সৎপাত্র’ বলে বাতিলের দলেই রেখেছিলাম। কিন্তু, ‘তারপর কী হইল জানে শ্যামলাল’। চার বছর হতে চলল গোরু চরাচ্ছি।
-চার কই, তোর পিএইচ.ডি-র তিন বছর হচ্ছে না?
-সাধে কি বলি গোরু? কবে থেকে প্রেম করছিস সে হিসেবও রাখতে পারিস না। ওইরকম অদ্ভুত দিনগুলো ভুলেই বা যাস কী করে!
-যেসব দিন ভাগ্যিস এসে পড়ে, তাদের মানুষ ভোলে না। কিন্তু আমি ইতিহাসে কাঁচা।
-তোর ইতিহাস যে লেখা হয়েছিল এর জন্যই আমাকে বুকার দেওয়া উচিত। এমনিতে তো আমাদের মধ্যে কোনও কিছু হওয়ারই কথা ছিল না, তাও যখন কিছু একটা হচ্ছে… তুই কিনা থার্ড দিনেই ফোন করবি বলে আমাকে বসিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়লি? কুম্ভকর্ণ তোর আবির্ভাবের কথা জেনেই নির্ঘাত হার্টফেল করেছিল।
-তাও তো হল। নিয়তি কে ন বাধ্যতে। ছোটবেলায় অঙ্কে শিখেছিলাম, দুটো সমান্তরাল সরলরেখা কোথায় মিলিত হয়। অসীমে, অর্থাৎ বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই। সরলরেখার মতোই দুটো জীবন, প্রায় সিমেট্রিক্যাল দুটো মানুষ যখন হঠাৎই কোথাও মিলে গেল, তখন নিয়তিকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
-এসব শুনলে ভবানীপুরটা আরও বেশি করে মিস করব। ভাল্লাগে না। যাক গে, শোন না, একদিন ডিউটি শেষ হলে রাতে চলে আয় না বাড়িতে। কাকিমার টেনশন কমবে একটু। তোদের জন্য ভীম না অর্জুন কীসব ট্রেন দিয়েছে বললি যে!
-এখন বাড়ি যাওয়ার প্রশ্নই নেই।
-আরে, কোনও ডাক্তার কি বাড়ি ফিরছে না? নিজে সাবধান থাকলেই তো হল। বেশি কাছে যাবি না কারও। এমনিই তো হসপিটাল থেকে ফিরলে কাকিমা তোকে স্নান না করিয়ে ঘরে তোলে না। দেখ, এক মাসের ওপর হতে চলল বাড়ি আসিসনি। সামনের দিনগুলো তো আরও বেশি আনসার্টেন। আয় না বাবা!
-তুই বলিস না, আমি আত্মকেন্দ্রিক, আমি স্বভাবত উদাসীন? জানিস, আমার মনে হয় মানুষকে বোধহয় অমন করেই গড়ে তোলা হয়েছিল। তার সাফল্য আর ব্যর্থতার সূত্র একসঙ্গে জুড়ে রেখে দিয়েছিলেন কোনও এক ঈশ্বর। তুই কী যেন একটা বলিস, বিপরীতের যুগ্মক, না? সাফল্যের দিকে এগোতে এগোতে মানুষ কোনও একদিন ভুলে যাবে আপনজন। সে শিখবে, দেয়ার ইজ অলওয়েজ ক্রাউড অ্যাট দ্য বটম, বাট দেয়ার ইজ অলওয়েজ রুম অ্যাট দ্য টপ। সেই শীর্ষে পৌঁছনোর তাগিদে সে ক্রমশ একা হবে।
-একা একা বাঁচা যায়?
-না তো। একা হয়ে যাওয়া মানুষ চিরকাল টিকে থাকতে পারবে না। ঠিক কখনও তার মনে পড়বে আপন করে নেওয়া মুখ। কারণ সে অনুভবে বাঁচে। সেভাবেও গড়া সে। আঘাতের আঙুল দিয়ে সে খুঁজবে পৃথিবীর সবচেয়ে তীব্র অনুভূতিকে। তখনই হয়তো নেমে আসবে ধ্বংস। সে ধ্বংস ঠোঁট ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়বে দেহে, দেহ চুঁইয়ে উঠে আসবে শ্বাস, সেই নিঃশ্বাসে পৃথিবীর বুক ভার হবে। ভারী হয়ে আসবে মানুষের চোখও। সেই আবহে শরীরটুকু টেনে এনে খুব প্রিয় মানুষের কাছে শুইয়ে দেবে সে।
ধ্বংস এসেছে। অতএব, এখন ভালোবাসা যায়…
-ধুর। একদম ভুলভাল বকবি না। ভালোবাসার কাছে ধ্বংস হেরে যায়। বরাবর। দিস টু, শ্যাল পাস।
-আমাদের এখানে প্রথম পজিটিভ ধরা পড়ল। আজকেই রিপোর্ট এসেছে। পাশের ডিপার্টমেন্টেই। আপাতত সিল করে দিচ্ছে, মোটামুটি সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে।
-মানে? এতক্ষণ ধরে তুই এটা বলিসনি?
-আই হেট টু ওয়েক য়ু আপ/ টু সে গুডবাই…
-থামবি তুই? হাবিজাবি বকছিস এখন?
-হাবিজাবি নয়, এটা গান। এটা যিনি লিখেছিলেন, তাঁর নামে আবার মানি হাইস্টের একটা চরিত্রও আছে। কে বল তো?
-তোর মনে হচ্ছে আমি ইয়ার্কি মারছি? এখন কুইজ করছিস? তুই বুঝতে পারছিস আমার কী অবস্থা? দিনে কতবার ট্র্যাকারটা চেক করি তুই জানিস? যে যুদ্ধে যায়, তার উদ্বেগ থাকে, কিন্তু উত্তেজনাও থাকে। সেটা একরকমের অ্যানেস্থেশিয়ার কাজ করে। কিন্তু যে বাড়িতে থাকে, যাকে একসঙ্গে দুটো লড়াই সামলাতে হয়, তার কথা কিন্তু কেউ ভাবে না। তোর চেয়ে বেশি খবর আমি ফেসবুক থেকে পাই। একটা কিচ্ছু বলিস না! মাস্ক আছে কি না, নিজের কাছে কোনও খাবার রেখেছিস কি না, জিজ্ঞেস করতে করতে আমার মুখ ব্যথা হয়ে যায়। এমনকি এই খবরটা অব্দি তুই দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিসনি।
-যেমন সব ভয়ের গল্পে
দত্যি দানো রাক্ষস আর ক্ষয়…
-ভালো লাগে না কিন্তু! বলছি একটা সিরিয়াস কথা…
-তিলে তিলে শুকায় রাজকুমারী
অন্ত্যমিলে রাজপুত্রের জয়…
-রাখলাম আমি!
-শোন, তার চেয়েও সিরিয়াস কথা হল, ইতালির ম্যানটোভায় একজোড়া কঙ্কাল পাওয়া গেছে।
-ডিসগাস্টিং!
-মাইন্ড ইট, ছহাজার বছরের পুরোনো কঙ্কাল। থুড়ি, কঙ্কাল যুগল। দুজন মানুষ পরস্পরকে জড়িয়ে থেকে, ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে মরে গেছিল। সুধা, এই পৃথিবী সব জুটিকে একসঙ্গে বাঁচার সুযোগ দেয় না হয়তো। কিন্তু শেষ লাইনটা একসঙ্গে লিখতে পারলেও তো রূপকথা জন্মায়, বল?