লকডাউনে খাদের কিনারায় দলিত, মুসলিম এবং আদিবাসীরা, পৌঁছোয়নি ত্রাণও; প্রকাশ সমীক্ষায়

করোনা মহামারীর ধাক্কা যে কত গভীরে আঘাত করেছে অর্থনীতিকে, তার নিদর্শন প্রকাশ পাচ্ছে রোজই। দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতিবিদেরা সন্দেহ প্রকাশ আসছিলেন যেভাবে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে সারা দেশে তার ধরণ নিয়ে। আশঙ্কা করা হয়েছিল, এর ফলে করোনার ধাক্কা কতটা সামাল দেওয়া যাবে তাতে সন্দেহ থাকলেও, দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের আর্থিক পরিস্থিতি যে চূড়ান্ত খারাপ হবে, সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সব আশঙ্কাই সত্যি হল অবশেষে। সম্প্রতি একটি সমীক্ষার রিপোর্ট সামনে এল এই তথ্যই। প্রমাণ হল যে, লকডাউন চলাকালীন দেশের লক্ষ লক্ষ লোক সম্মুখীন হয়েছেন জীবিকা ও খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতায়। বিশেষ করে পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে উঠেছে প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। দেশের মোট ১১টি রাজ্যের প্রায় ১ লক্ষ পরিবারের উপর চালানো সমীক্ষায় উঠে এসেছে এমনই ভয়াবহ তথ্য।

সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, দলিত, মুসলমান, আদিবাসী এবং যাযাবর প্রজাতির মানুষেরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এই লকডাউনের ফলে। আর্থিক পরিস্থিতি সামাল দিতে অত্যন্ত উচ্চ হারের সুদে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। পেটের জ্বালায় নেওয়া এই ঋণ আদৌ তাঁরা কোনোদিন শোধ দিতে পারবেন কিনা তার কোনও উত্তর জানা নেই তাঁদের। এর জন্য ঘটি-বাটি বিকিয়ে দিয়ে রাস্তায় বসতে হবে কিনা, সে কথাও নিশ্চিত ভাবে ভাবার মতো পরিস্থিতি ছিল না তখন তাঁদের।

রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে, এই সকল সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ লোকেরা সরকারী ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ত্রাণ বিলির সময়ে বৈষম্যের মুখোমুখি হওয়াই এই বঞ্চনার কারণ বলে উঠে এসেছে দিল্লি-ভিত্তিক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায়। সমীক্ষাতে পরিষ্কার যে, এই চরম আর্থিক দুর্দশার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই সম্প্রদায়ের শিশুদের পড়াশোনাও। স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েছে ব্যপক হারে। পরিবারকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করার জন্য শিশুদেরকেও লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে কোনও না কোনও কাজে।

এছাড়াও রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে যে লকডাউনের মধ্যে এই জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্রতর হয়েছে বঞ্চনা ও বৈষম্য। তীব্র আর্থিক সংকটের ফলে বহু মানুষই ‘বন্ডেড লেবার’ বা ‘বাঁধা শ্রমিক’-এ পরিণত হতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে রিপোর্টে।

বেসরকারি উদ্যোগের এই সমীক্ষায় মাথায় রাখা হয়েছিল কয়েকটি মূল ব্যাপার। যেমন, সরকারি স্কিম এবং সুবিধার আওতায় কতটা যোগদান করতে পারছে এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা, চাকরি ও জীবিকা নির্বাহের মতো সামাজিক সমস্যাগুলিকে কীভাবে সামাল দিতে পারছে, ঋণের দায় কতখানি চাপছে তাঁদের উপর ইত্যাদি।

বিহার, ছত্তিশগড়, গুজরাত, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, উড়িষ্যা, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো ১১টি রাজ্যের মোট ৪৭৬ টি অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে চালানো হয় এই সমীক্ষা। শ্রেণীগতভাবে মুসলিমরা হলেন ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। আবার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তম হল দলিত সম্প্রদায়। এছাড়াও সারা বিশ্বের মধ্যে সবথেকে বেশি আদিবাসী মানুষ বসবাস করেন ভারতেই। ভারতে চিহ্নিত করা গেছে এমন উপজাতির সংখ্যা ৭০৫। তাছাড়াও অচিহ্নিত তথা যাযাবর প্রজাতিভুক্ত মানুষের সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, ব্রিটিশ শাসনের সময় এইসকল সম্প্রদায়কে ‘অপরাধী উপজাতি আইন, ১৮৭১’-এর অধীনে উল্লেখ করা হয়েছিল। বর্তমানেও এই মানুষগুলোর প্রতি দেশবাসী বা সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ বদলেছে বলে মনে হয় না।

আরও পড়ুন
১৪ মাসে আত্মহত্যা ১৩ কর্মীর, ছাঁটাইয়ের পথে আরও ২০ হাজার; খাদের কিনারায় বিএসএনএল?

কিন্তু ঠিক কখন থেকে খারাপ হতে শুরু করল এই পরিস্থিতি? দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে সিঁদুরে মেঘ দেখা যাচ্ছিল করোনা প্রকোপের আগে থেকেই। তার মধ্যেই লকডাউন ঘোষণার ফলে দেশবাসী যেমন একদিকে কর্মহীন হয়ে পড়তে শুরু করে, অন্যদিকে অসংগঠিত শ্রমিকদের বিপরীত অভিবাসন বা রিভার্স মাইগ্রেশনও শুরু হয়ে যায়। একাধিক বিধিনিষেধ আনা হয় সরকারের তরফ থেকে। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল এইসময়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রান্তিক সম্প্রদায়ের লোকেরা এই প্রকল্পের আওতায় কোনও কাজ পাননি। বিশেষ করে অচিহ্নিত উপজাতির মানুষেরা এই প্রকল্পের অধীনে কোনও কাজই পাননি বলে জানানো হয়েছে, কারণ এই প্রকল্পে তাঁদের জন্য কোনও কাজই নির্ধারিত ছিল না।

লকডাউনের আর্থিক ক্ষতি থেকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য গত মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় সরকার ১.৭ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু আদতে এই প্যাকেজটি ছিল পুরনো স্কিমগুলি নতুন মোড়কে প্রকাশ করা। দেখা গেছে যে, এই সমস্ত বেশিরভাগ যোজনাতেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাগজপত্র, দলিল ইত্যাদির অভাবেই এই যোজনায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি বলে জানানো হয়েছে। যেসব অঞ্চলে সমীক্ষা করা হয়েছে, তার ৭০ শতাংশেরও বেশি জায়গায় দেখা গিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা। দেখা গিয়েছে, যে সকল পরিযায়ী শ্রমিকেরা নিজের গ্রামে ফিরে এসেছিলেন, তাঁরা সরকারি ত্রাণ তহবিলেও নথিভুক্ত হতে পারেননি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, লকডাউন পরিস্থিতিতে ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমাজের এই সকল মানুষেরা। একদিকে যেমন দেশকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর কথা হচ্ছে বলা হচ্ছে, বলা হচ্ছে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র কথা, সেখানে অন্যদিকে দেশেরই কিছু মানুষ ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে আরও অন্ধকারে। এদের আলোর দিশা দেখানোর কোনও দায় বা সদিচ্ছা কি আদৌ সরকারের আছে?

আরও পড়ুন
পাবজি-ফৌজি চর্চা, রবীন্দ্রনাথ ও কিছু 'হযবরল'

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More