পরনে কালচে নোংরা গেঞ্জি। তার ওপরেই চাপানো আর্জেন্টিনার জার্সি। না, সে জার্সি অবশ্য কাপড়ের নয়। বরং, তৈরি নীল-সাদা প্লাস্টিক দিয়ে। ওপরে কালো কালিতে লেখা মেসি(Messi)র নাম, জার্সির নম্বর। ২০১৬ সালের কথা। সোশ্যাল মিডিয়ায় হঠাৎ করেই ভাইরাল হয়েছিল বছর পাঁচেকের এক খুদে মেসিভক্তের এহেন ভিডিও। ধূসর মরুপ্রান্তরে ফুটবল নিয়ে ছুটে চলেছে সে। হ্যাঁ, জায়গাটা আফগানিস্তান। কিন্তু এই মেসিভক্তিই যে বিপদ নিয়ে আসবে, তখন আর কে-ই বা জানত? মুর্তাজা আহমাদি(Murtaza Ahmadi)। অল্পদিনের মধ্যেই সেই খুদে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল তালিবানদের। এক কথায় দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তার জীবন। এবার প্রাণ বাঁচাতে অন্য দেশে জায়গা পাওয়ার কাতর আর্জি জানাল মুর্তাজা।
কিন্তু তালিবানের সঙ্গে তার এই সংঘাতের কারণ কী? উত্তর পেতে ফিরে যেতে হবে সেই শুরুর দিনগুলোতে। ছোট্ট মুর্তাজার ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিও পৌঁছে গিয়েছিল স্বয়ং মেসির কাছে। তারপর নিজ উদ্যোগেই খুদে সমর্থকের সঙ্গে কাতারে দেখা করেছিলেন ফুটবল রাজপুত্র। নিজের দুটি জার্সি এবং একটি স্বাক্ষরিত ফুটবলও মেসি উপহার দিয়েছিলেন মুর্তাজাকে। এমনকি ম্যাচ শুরুর আগে উদ্বোধনী সঙ্গীত গাওয়ার সময়ও মেসির পাশে হাজির থাকতে দেখা গিয়েছিল তাকে।
সেই ঘটনাই রাতারাতি বিখ্যাত করে দিয়েছিল খুদে আফগান ফুটবলপ্রেমীকে। এমনকি গোটা বিশ্বের কাছে তার পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘খুদে মেসি’। মুর্তাজার আন্তর্জাতিক এই খ্যাতি ডেকে আনে বিপত্তি। মুর্তাজা সেসময়কার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিল, তরুণ প্রজন্ম ফুটবল খেলুক, তা তালিবানরা চায় না। উপরন্তু তার পরিবার হাজারা শিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। আর এই সম্প্রদায় তালিবানের ‘চিরশত্রু’। তালিবান শাসনের পূর্ববর্তী অধ্যায়েও এই সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপরে চলেছিল অকথ্য অত্যাচার।
২০১৬ সালে আফগানিস্তানে গণতান্ত্রিক সরকার থাকলেও, মুর্তাজার খ্যাতির জন্য গজনি প্রদেশে বিক্ষিপ্তভাবে নেমে আসে তালিবানি আক্রমণ। একাধিক প্রাণনাশের হুমকিও এসে পৌঁছায় খুদে ফুটবলপ্রেমীর পরিবারের কাছে। বাধ্য হয়েই তালিবানের ভয়ে, ঘর ছাড়তে হয় তাদের। প্রাথমিকভাবে জুটেছিল বামিয়ান প্রদেশে। পরে সেখান থেকে ছোট্ট মুর্তাজাকে কাবুলে তার কাকার কাছে পাঠিয়ে দেয় তার পরিবার।
আরও পড়ুন
অলিম্পিয়ান ফুটবলার থেকে আন্তর্জাতিক রেফারি, বৈচিত্র্যময় জীবনের ইতি
কাবুলে যেন একটুকরো খোলা আকাশ পেয়েছিল মুর্তাজা। পেয়েছিল দম নেওয়ার সামান্য অবকাশ। বিগত ৩ বছর সেখানেই নিশ্চিন্তে নিরাপদে বেড়ে উঠছিল সে। কিন্তু চোখের নিমেষেই বদলে গেল সবকিছু। গত আগস্ট মাসেই তালিবান দখল নেয় কাবুলের। সেই থেকেই সম্পূর্ণ গৃহবন্দি মুর্তাজা। এক প্রকার আত্মগোপন করেই তাকে থাকতে হচ্ছে গোপন ডেরায়। তার সঙ্গে রয়েছেন ২২ বছরের অবিবাহিত দিদি। ফলত, হাড় হিম করা আতঙ্কের মধ্যেই দিন কাটাতে হচ্ছে তাকে।
আরও পড়ুন
স্থূলতার জন্য ব্যঙ্গের শিকার, ফুটবলের মাঠেই জবাব দিয়েছিলেন মুলার
সপ্তাহ দেড়েক আগে আফগান সংবাদমাধ্যম ইএফই-র কাছে মুর্তাজা কাতর আর্জি জানিয়েছিল, যাতে অন্য কোনো দেশে তাঁকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। তবে মুর্তাজার খবর নেই কোনো। আদৌ তাকে এখনও কাবুলেই লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে না সুযোগ এসেছে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার— তা জানা নেই কারোরই। এই রাজনৈতিক দোলাচলের মধ্যে বছর দশেকের মুর্তাজার জন্য উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক ফুটবল সমর্থকরাও…
আরও পড়ুন
আরবি ইতিহাসের ছোঁয়ায় সেজে উঠছে ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপের মঞ্চ
Powered by Froala Editor