তৃতীয় পর্ব
দেখতে দেখতে শেষের পথে এবারের বইমেলা। অন্তিম লগ্নে এসে এই উন্মাদনা খানিক জাপটে ধরে রাখছে বইপোকারা। অন্যান্য বারের মতো লিটল ম্যাগাজিন টেবিলগুলোও ভরে উঠেছে নতুন লেখার গন্ধে। নতুনের পাশাপাশি সেখানে রয়েছে অন্যান্য পত্রিকা, বই। বাংলা সাহিত্যের এই যজ্ঞশালা থেকে বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনা করছে প্রহর। সেরকমই নির্বাচিত আরও ছয়টি পত্রিকা রইল এই পর্বে—
মুখর
"পৃথিবীর হাড়ে হাড়ে নিদারুণ দাবানল জ্বলে,
অবিরাম যে পৃথিবী ঘৃণাভরে করেছে আঘাত,
সে এখন ডেকে ওঠে: দীপক— দীপক, তুমি শোনো,
আলোকলগ্নের আগে অন্তত একবার জাগো।"
পৃথিবীর এই আকুল স্বরের সঙ্গেই যেন নিজেকে মিলিয়েছেন কবি দীপক দত্ত। নীলেশ গায়েনের সম্পাদনায় 'মুখর' পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যা তাঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে করা হয়েছে। দীপক দত্তের বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এবং কিছু কবিতা স্থান পেয়েছে এখানে। রয়েছে কবি'র অপ্রকাশিত কয়েকটি কবিতাও। পত্রিকাটির একটি বড় অংশই তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। রয়েছে দেবাশিস আচার্যের লেখা কবি দীপক দত্তকে নিয়ে একটি বিশেষ আলোচনা। কবিতায় প্রবেশ করার আগে এই আলোচনা পাঠকদের ধারণা দেবে কবিতাগুলো সম্পর্কে।
এছাড়াও রয়েছে সাধারণ বিভাগ। প্রবীণ-নবীন বেশ কয়েকজন কবির কবিতা নিয়ে সেজে উঠেছে পত্রিকার পরবর্তী অংশ। রয়েছে 'সাহা সমীকরণের' শতবর্ষ নিয়ে ড. অমিতলাল ভট্টাচার্যের বিশেষ প্রবন্ধ। শুভদীপ সেনশর্মার প্রচ্ছদ ও নামাঙ্কনে সেজে উঠেছে 'মুখর'।
বৃষ্টিদিন
একসময় তরুণ কবিদের মঞ্চ ছিল এই পত্রিকা। শূন্য দশকের বহু কবির যাত্রা শুরু হয়েছিল এখানে। বেশ কিছু বছর বন্ধ থাকার পর, আবারও স্বমহিমায় ফিরল 'বৃষ্টিদিন' পত্রিকা। সম্পাদক হিসেবে পুরনো দায়িত্বে ফিরলেন কবি মন্দাক্রান্তা সেন এবং অরিনিন্দম মুখোপাধ্যায়।
শুরুর দিন থেকে তরুণদের আত্মপ্রকাশের মঞ্চ হিসেবেই নিজেদের চিনিয়েছিল 'বৃষ্টিদিন'। এবারেও তার অন্যথা হয়নি। একঝাঁক তরুণদের লেখা গুচ্ছ কবিতা দিয়ে সেজে উঠেছে এবারের সংখ্যা। বইয়ের একদম প্রথমে আটলাইনের একটি শিরোনামহীন কবিতায় ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে বর্তমান ভারতের অবস্থাকে। পিয়াল ভট্টাচার্যের প্রবন্ধে উঠে এসেছে কবিতা এবং নাটক, নাটকীয়তার মেলবন্ধনের বিষয়টি। প্রাচীন ভারতের 'নাট্যশাস্ত্র' থেকে আধুনিক কালের মল্লিকা সেনগুপ্ত — অনেক কবির কবিতাই উঠে এসেছে এই আলোচনায়। শুধু বাংলা নয়, এখানে প্রাবন্ধিক ফিরে গেছেন হিন্দি সাহিত্যের দিকেও।
কবিতা আর ছন্দ— এই দুটি যেন অভিন্ন হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। ছন্দছাড়া কবিতা লেখার পরিমাণ অনেক বেশি হলেও, ছন্দকে যে জানতে হবে, সেটাই বারবার বলে এসেছেন অগ্রজ কবিরা। ছন্দের নাড়ি-নক্ষত্র সবকিছুর হদিশই পাওয়া গেল যশোধরা রায়চৌধুরীর লেখায়। তবে তিনি লেখার শুরুতেই বলে দিয়েছেন, এটি আসলে 'টুকলিভরা নোটখাতা'। এছাড়াও সুস্নাত চৌধুরীর আলোচনায় ছোট পত্রিকার মুদ্রণ বিষয়ক লেখা এবং সোমব্রত সরকারের আলোচনায় বাউল-ফকিরদের দেহতত্ত্ব ও কবিতার আলোচনা উৎসাহী পাঠককে আকর্ষণ করবে। সেই সঙ্গে আছে তরুণদের এক গুচ্ছ কবিতা। সব মিলিয়ে, 'বৃষ্টিদিন'-এর যাত্রা নতুন ভাবে শুরু হল।
জানালা
"লিটল ম্যাগাজিনের নাম শুনি বটে,কিন্তু লিটল কোথায়? লিটল হয়ে থাকতে কেউ কি চাইছে আর? লিটল প্রিন্সের মত সরল হতে পারছি কি আর?"
লিটল ম্যাগাজিনের অতীতে, বর্তমানে এই প্রশ্নটি নানা মহল থেকে উঠেছে। একই প্রশ্ন উঠেছে 'জানালা' পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যাতেও। দেবাশিস তরফদার পরিবেশিত এই পত্রিকায় মূলত অনুবাদের কাজই দেখা গেছে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের 'Today is Friday'-এর অনুবাদ 'আজ শুক্রবার' দিয়ে শুরু পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যা।
আন্দ্রেয়া কামিল্লেরি'র উপন্যাসের ছোট একটি অংশের অনুবাদ 'একটি তুচ্ছ পাগলামির গল্প' এবং কোবায়াশি ইসা'র শতাধিক হাইকু এই সংখ্যার অন্যতম আকর্ষণ। বর্তমান বিশ্বের নানা ঘটনা স্থান পেয়েছে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে। সেখানে যেমন এসেছে সিরিয়ার পরিস্থিতি ও শরনার্থী প্রসঙ্গ, তেমনই এসেছে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি ও তার প্রয়োগ-ভবিষ্যত নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। সমাজের বর্তমান অশান্ত অবস্থা, যুদ্ধ— এই সবকিছু ছুঁয়ে গেছে গোটা পত্রিকায়। পাঠক 'জানালা' খুলে যাতে মুক্ত চোখে সেসব দেখতে পারে, বিচার করতে পারে, সেটাই চেয়েছেন সম্পাদক।
ইতিকথা এখন
বাংলা লিটল ম্যাগাজিন জগতে 'ইতিকথা এখন' একটি পরিচিত নাম। পত্রিকার পাশাপাশি প্রকাশনার কাজেও নিজেদের এগিয়ে নিয়ে গেছেন তারা। পত্রিকা বলতেই কবিতা-গদ্য-সাক্ষাৎকার-আলোচনা এই সবকিছুর কথা মাথায় আসে আমাদের। ইতিকথা'র সাম্প্রতিক সংখ্যায় জায়গা পেয়েছে শুধু গদ্য।
এপার-ওপার, দুই বাংলার লেখকদের নিয়ে সাজানো এই গদ্য সংখ্যা। এই সংখ্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ কবি বিকাশ গায়েনের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। এর আগে আর কোথাও ওঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়নি। সেই দিক থেকে এই সংখ্যা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তরুণ কবি শুভম চক্রবর্তীকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে যেমন উঠে এসেছে কবি'র কবিতা বোধ, ভাবনা; তেমনই উঠে এসেছে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়া, শ্লীলতা-অশ্লীলতা, লিটল ম্যাগাজিন— সমস্ত বিষয় নিয়ে অকপট থেকেছেন কবি বিকাশ গায়েন।
এছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু গদ্য, গল্প, প্রবন্ধ। অরুণকুমার দত্ত, শুভ্রা মুখার্জি, অভিষেক মুখোপাধ্যায়, স্রোতস্বিনী চট্টোপাধ্যায়, শুভম চক্রবর্তী প্রমুখের গদ্য পাঠকদের নজর কাড়বে। বাংলাদেশ থেকে লিখেছেন পিয়াস মজিদ, ওবায়েদ আকাশ। রয়েছে তিনটি কাব্যগ্রন্থ ও একটি উপন্যাসের আলোচনা। রাজদীপ পুরীর প্রচ্ছদে আরও রঙিন হয়ে উঠেছে 'ইতিকথা এখন'-র এই গদ্য সংখ্যা।
নাটমন্দির
'নানা রকমের লেখা সারা পৃথিবীতে লেখা হয়েছে। সব লেখা তো আমি পড়িনি। এমনিই কম পড়ি, কিন্তু যে কবিতা বা সাহিত্য পড়ি তা যেন এই জীবনের হেঁটে যাওয়ার পথের অনিবার্য, আরও কিছু, বিস্তৃত পথ। যা আমার আয়ুকে আরও কিঞ্চিত বাড়িয়ে দেয়'।
নিজের ব্যক্তিগত গদ্যে এভাবেই কবিতাকে দেখেছেন রাণা রায়চৌধুরী। এই দেখা তাঁর একার নয়, এই দেখা 'নাটমন্দিরেরও'। নব্বই দশক থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এই ক্ষীণতনু পত্রিকাটি। দেখতে দেখতে ২৫ বছর অতিক্রম করল। আজও লিটল ম্যাগাজিন জগতের অন্যতম একটি নাম 'নাটমন্দির'। ৬৭তম সংখ্যাও বেশ কিছু কবির কবিতা দিয়ে সাজিয়েছেন সম্পাদকরা। গৌরাঙ্গ শ্রীবাল, সঞ্চিতা দাস, সুদক্ষিণা, সম্বিত বসু, কৌস্তভ কুণ্ডুর মত আরও বেশ কয়েকজনের লেখা জায়গা করে নিয়েছে এই সংখ্যায়। 'খুলতে খুলতে খুলে গেল বন্ধন/ এখন আর কোনো হা-হুতাশ নেই'— কৌস্তভ কুণ্ডুর লেখা এই লাইনটিই কবিতার বন্ধনকে মুক্ত করার কথা বলে। শুধুই কি কবিতা? আমরা, আমাদের চারপাশটা, আমাদের জীবনটাও কি বেঁধে পড়েনি কোথাও? আমরা কি সেই বাঁধন চাই আদৌ? প্রশ্নগুলো উঠে আসবে পাঠকের মনে।
পত্রিকাটি শেষ হয়েছে রাণা রায়চৌধুরীর গদ্য 'অল্প আলোর সন্ধানে' দিয়ে। কবিতা যে তীব্র একটি ঝাঁকুনি, সেই কথাই বলেছেন তিনি। মণীন্দ্র গুপ্ত, বিনয় মজুমদার, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত'র কথা উঠে এসেছে এই লেখায়।
সদর স্ট্রিটের বারান্দা
অনুবাদ বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ জঁর। শুধু বিদেশি লেখকদের লেখাই নয়, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লেখাও অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে আমাদের সহজলভ্য হয়ে ওঠে। এবার ভারতের অন্যান্য ভাষার লেখকদের গল্পের অনুবাদেই সেজেছে 'সদর স্ট্রিটের বারান্দা'-র সাম্প্রতিক সংস্করণ।
'বারান্দা যেখানে শেষ সেখান থেকে শুরু হয় রাস্তা। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বদলে যায় পাড়া। প্রত্যেক পাড়ার আলাদা আলাদা গন্ধ'। আর সেই নতুন পুরনো গন্ধ নিয়ে পথ চলা এই পত্রিকার। মূল ভাবনা ঈশানী বসাকের। অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের অনুবাদই এখানে প্রধান বিষয়। উর্দু, মালয়ালম, খাসি, হিন্দি, অসমীয়া, বোড়ো— ছয়টি ভাষার সাতটি গল্প স্থান পেয়েছে এই সংখ্যায়। পত্রিকা শুরু করেছেন সাদাত হাসান মান্টো। তাঁর বিখ্যাত গল্প 'ঠান্ডা গোস্ত'-র অনুবাদ করেছেন অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। এছাড়াও অনুবাদ করেছেন দেবব্রত কর বিশ্বাস, তমাল রায়, শবরী শর্মা রায়, দোলনচাঁপা চক্রবর্তী, শুভদীপ মৈত্র এবং অভিজিৎ লাহিড়ী। গল্প নিয়েই করা হয়েছে এবারের সংখ্যা। প্রচ্ছদ করেছেন পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়।