কেউ চাকরি করেন, কেউ পড়াশুনা, দিনের শেষে একটাই নেশা, লিটল ম্যাগাজিন, আর সেই টানেই ছুটে যাওয়া বইমেলায়। বছরের পর বছর ধরে বহু পরিশ্রমে একটি বা দুটি করে সংখ্যা প্রকাশ। হ্যাঁ লিটল ম্যাগাজিনেরই ছবি ফুটে উঠছে চোখে। কিন্তু এর পিছনে রয়েছে অঢেল ঘাম, রক্ত জল করা খাটনি। ছোট পত্রিকা আসলে এক টিম গেম। যেখানে সমস্ত পাস ঠিকমতো না হলে ছত্রাখান হয়ে যায় খেলা। প্রহর এবছর সম্মান জানাতে চলেছে এমনই দুটি পত্রিকাকে। তার আগে জমা পড়া অঢেল পত্রিকার মধ্যে প্রথম বাছাইয়ের কিছু পত্রিকার রিভিউ আমরা পৌঁছে দেব বিশ্বব্যাপী বাঙালি পাঠকের দরবারে। আসুন পড়ে নেওয়া যাক আজকের বাছাই ছটি পত্রিকার আলোচনা।
রাবণ
‘একটি আত্মকথার ষাণ্মাসিক’। শুনতে অবাক লাগলেও, বাংলায় এমনও একটি পত্রিকা রয়েছে। নাম, ‘রাবণ’। প্রতি সংখ্যায় ছাপা হয় নির্বাচিত কিছু মানুষের আত্মকাহিনি। সম্পাদক সোমাইয়া আখতারের কথায়, ‘প্রতিটি মানুষের জীবনকথা, তাঁর পারিপার্শ্বিক জীবন, তিনি যেভাবে লেখেন সেভাবেই প্রকাশিত হয়।’
রাবণের ষষ্ঠ সংখ্যায় রয়েছে মেজর সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আত্মকথার পুনর্মুদ্রণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ইংরেজ সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন তিনি। বন্দি হন জাপানিদের হাতে। ঠাঁই হয় ক্যাম্পে। পরবর্তীকালে, যোগ দেন আজাদ হিন্দ ফৌজে। বর্ণময় সেই সময়ের স্মৃতিচারণ রয়েছে এই সংখ্যায়, যা এক বিশেষ আকর্ষণ।
এছাড়াও রয়েছে সুখময়ী বসুর আত্মকথন। তিনি ১৯৪৭-এর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম হোক কিংবা ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – বিপ্লবীদের সহযোগিতায় তিনি ছিলেন তৎপর। রয়েছে তাহাজিবুন্নেসা, জয়া মিত্র, আসরফী খাতুন, সোমেন মুখোপাধ্যায় ও সোমাইয়া আখতারের লেখাও। আত্মকথার এমন পত্রিকা সত্যিই বিস্ময় জাগায় পাঠকের মনে।
রাবণের ষষ্ঠ সংখ্যাটির প্রচ্ছদ করেছেন কৃষ্ণেন্দু চাকী। বিভিন্ন মানুষের জীবনকাহিনি তাঁদের নিজেদের বয়ানেই পড়তে হলে, রাবণের মতো সমসাময়িক পত্রিকা সত্যিই দুর্লভ।
প্রতিবিম্ব
‘আমন্ত্রিত সম্পাদকীয়! সে আবার কী! আমন্ত্রিত শিল্পী শুনেছি, আমন্ত্রিত সম্পাদক শুনেছি, আমন্ত্রিত সম্পাদকীয় বলে তো কিছু শুনিনি!’
লিখেছেন প্রচেত গুপ্ত। ‘প্রতিবিম্ব’ পত্রিকার সাম্প্রতিকতম সংখ্যায়, ‘আমন্ত্রিত সম্পাদকীয়তে। বহুকাল আগে, দীপক মজুমদার নাকি তাঁর ‘গোলকধাঁধাঁ’ পত্রিকায় আমন্তত্রিত সম্পাদকীয় লিখতে বলেছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। প্রতিবিম্ব-এর সম্পাদক প্রশান্ত মাজীও সেটাই করেছেন। প্রচেত গুপ্তকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন একটি তরতাজা সম্পাদকীয়।
এমনই অভিনবত্ব দিয়ে শুরু পত্রিকাটি। তবে শুধু এটিই নয়, পত্রিকার ভেতরে ছড়িয়ে রয়েছে আরও মণি-মাণিক্য। শঙ্খ ঘোষের ভাষণ, গৌরকিশোর ঘোষ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মতি নন্দী, মণীন্দ্র গুপ্তের অগ্রন্থিত লেখার পুনর্মুদ্রণ। রয়েছে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের অগ্রন্থিত লেখা, তাঁর অনূদিত কবিতা। আরও বিস্ময়কর, সন্দীপনের নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারও সংকলিত হয়েছে পত্রিকাটির এই সংখ্যায়। এছাড়াও, রয়েছে জয় গোস্বামীর কবিতা, তাঁর সাক্ষাৎকার এবং জয় সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষের একটি লেখাও। রাহুল পুরকায়স্থ, দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কল্যাণ মিত্র ও আরও অনেক তরুণ কবির কবিতাও এ-সংখ্যার সম্পদ।
পত্রিকাটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন সম্বিত বসু। নামাঙ্কন পেয়েছে হিরণ মিত্রের ছোঁয়া। পাঠকও ছুঁয়ে দেখতেই পারেন প্রতিবিম্বের সাম্প্রতিকতম সংখ্যাটি।
দশমিক
‘…আজকাল যাঁরা নতুন কবিতা লিখছেন… কোনোরকমে ভাঙাচোরা কয়েকটি লাইন পর-পর সাজিয়ে – না, সাজিয়ে কথাটা ভুল হ’লো – পর-পর বসিয়ে ছাপাবার জন্য অধীর হ’ইয়ে পড়েন তাঁরা, এবং যা-হোক একটি বই যদি বের করতে পারেন, অমানুষিক শ্রম করেন তার প্রশংসাপত্র সংগ্রহের জন্য।…’
ওপরের কথাগুলি লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকায়। বুদ্ধদেব বসুর সেই কথাগুলিই ঠাঁই পেয়েছে ‘দশমিক’ পত্রিকার ব্যাক কভারে, ‘পঞ্চম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা’য়।
সম্পাদক পৃথ্বী বসু সম্পাদকীয়তে লিখেছেন এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা। নবতিপর কবি শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় তখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, মেডিক্যাল কলেজে। তখনও তিনি বলেছেন - ‘আত্মসম্মান সবার আগে। কোনোদিন ভুলে যেও না, তুমি একজন কবি।’ এই যে সাহস, কবির স্পর্ধা হয়তো বা, পত্রিকাটির পাতায় পাতায় ছড়ানো।
সুসম্পাদিত এই পত্রিকার অন্যতম আকর্ষণ কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের লেখা ২২টি চিঠি। এছাড়াও রয়েছে দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও সাম্যব্রত জোয়ারদারের স্মৃতিচারণ, ছবি আঁকা নিয়ে বিকাশ ভট্টাচার্যের নিবন্ধ। রয়েছে কয়েকজন কবির কবিতাভাবনা ও কবিতাও। সব মিলিয়ে, প্রকাশ কর্মকারের প্রচ্ছদে সজ্জিত এই পত্রিকাটি সাম্প্রতিক লিটল ম্যাগাজিনগুলির মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য।
ডাকবাক্স
লিটল ম্যাগাজিনের অন্যতম আশ্রয় তার কবিতার পাতা। দশকের পর দশক ধরে অজস্র কবিতা পত্রিকা এসেছে, হারিয়েও গেছে। কিন্তু ফুরোয়নি ধারা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়েছে কেবল। সায়ক চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘ডাকবাক্স’ তেমনই এক পত্রিকা। যার সাম্প্রতিক কবিতা সংখ্যা বাংলা কবিতার আবহমান ধারাটিকেই তুলে আনে।
সহ সম্পাদক স্বাগত লেখেন, ‘মাঝরাত্তিরে ঘুমের নিচ থেকে বেজে উঠছে প্রাচীন রিংটোন, হারিয়ে যাওয়া মেঘের দিনের চরিত্রদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে স্বপ্নে। বাতিল ট্রামলাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে যে, তাকে মনে হচ্ছে খুব চেনা। আর এই সবটুকু লিখে রাখার জন্যই ডাকবাক্স-র এবারের ফিরে আসা’। পত্রিকার পাতায় পাতায় কবিতাও এই রূপকথার গল্পই বলে। যে কারণে পৃথ্বী বসু লেখেন –‘লিখতে এসেছি বলে/এত ফুল, এত উদযাপন/কোনোদিন লেখা যদি থেমে যায়/দুঃখ হবে না’। শুভদীপ চক্রবর্তী সাজিয়ে রাখেন ‘তার বাড়ির নাম নূপুর। সেখানে রিনরিন বাজেনি অনেকদিন’-এর মতো লাইন।
‘চাষী জানে, রাখালের জন্য কোথাও এক জাহাজ অপেক্ষা করে থাকে। তাই রাখালের সামনে কখনও জলের, পাহাড়ের, সমুদ্রের গল্প বলতে নেই…’ – অভিষেক চক্রবর্তীর লেখা এই বিষণ্ণ উদযাপনই যেন পত্রিকাটির প্রাণ। সায়নী কুণ্ডুর প্রচ্ছদে যা শহরের রাত্রির ছোঁয়া পেয়েছে।
জঙ্গলমহল
‘দু-জন দু-ভাবে পড়ে থাকব লাশ হয়ে
বেওয়ারিশ ভারতবর্ষে একা একা দুজন মানুষ’
সৌম্যজিৎ রজকের এই লাইনদুটিই যেন ‘জঙ্গলমহল’ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যার পরিচয়। রঞ্জন আচার্যের সম্পাদনায়, পুরুলিয়া থেকে প্রকাশিত এই কাগজটি ইতিমধ্যেই পাঠকের সম্মান লাভ করেছে। আর সাম্প্রতিক সংখ্যাটি যেন ভারতবর্ষের বর্তমান অবস্থাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে তিলে-তিলে।
প্রথমেই রয়েছে ডঃ রাম পুনিয়ানির একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে অস্থির ভারতের একজন পরিচিত প্রতিবাদী মুখ ডঃ রাম পুনিয়ানি। তিনি বলেন, ‘একটি গার্ডিয়ান স্টেটের মতো সব মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে চলে এমন রাষ্ট্রই হল সেক্যুলার রাষ্ট্র। আর মন্দিরের দেখভাল করা, মসজিদের দেখভাল করা এসব রাষ্ট্রের কাজ নয়।’ স্পষ্ট ও দৃঢ় বক্তব্যে বুঝিয়ে দেন তাঁর অবস্থান। একইসঙ্গে, মৌসুমী ভৌমিকের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও এই সংখ্যার সম্পদ, যাতে উঠে এসেছে তাঁর শিল্পীজীবনের বহু খুঁটিনাটিই।
কাজী নজরুল ইসলামের গান নিয়ে শেখ আজহারুল হকের প্রবন্ধ, পঙ্কজ চক্রবর্তীর কবিতা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রয়েছে ইরাকী-আমেরিকান কবি দুনিয়া মিখাইলের কবিতার অনুবাদও। ছিমছাম অথচ ঋজু পত্রিকা, যা লিটল ম্যাগাজিনের স্বভাব, তার অন্যতম উদাহরণ হয়ে রইল ‘জঙ্গলমহল’-এর এই সংখ্যাটি।
পদক্ষেপ পত্রিকা (চুঁচুড়া)
‘…হঠাৎ দুপুর ২.৩০ নাগাদ অপ্রস্তুত সত্যাগ্রহীদের ওপর বিনা প্ররোচনায় শুরু হল পুলিশের গুলিবর্ষণ। ঘটনার আকস্মিকতায় সমবেত জনতা ও সত্যাগ্রহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটতে লাগলেন। গুলিবর্ষণে ঘটনাস্থলেই প্রাণ গেল নয়জন সংগ্রামীর। এর দুদিন পর প্রাণ গেল আরও দুজন গুরুতর আহত সংগ্রামীর।’
লিখেছেন অরুণিমা (দে) ভট্টাচার্য, পদক্ষেপ পত্রিকা(চুঁচুড়া)র সাম্প্রতিক সংখ্যায়। ১৯৬১ সালে বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর প্রবন্ধটি এই পত্রিকার সম্পদ। এছাড়াও একই বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ লিখেছেন দিলীপকান্তি নস্করও। রয়েছে বাঙালি বিদ্বেষের রাজনীতি নিয়ে দয়াসাগর কলিতার প্রবন্ধের অনুবাদ। এই তিনটি লেখা এই পত্রিকার সম্পদ। উল্লেখযোগ্য আশিষ রঞ্জন নাথের লেখা ‘বাংলা কবিতায় বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের প্রভাব’ প্রবন্ধটিও।
নির্মলেন্দু কুণ্ডু সম্পাদিত ‘পদক্ষেপ’ পত্রিকার এই সংখ্যার প্রচ্ছদশিল্পী সমীরণ ঘোষ।