পৃথিবী এবং মানুষের ইতিহাস ভারী আকর্ষণীয়। প্রতিটা বাঁকেই নজরে পড়বে নানা স্তর। এক একটা অধ্যায় ধরে আমাদের যাত্রা প্রাচীন সভ্যতার দিকে। যেখানে ঘটে চলেছে কত না ঘটনা। সেখানে যেমন আছে যুদ্ধ, আছে ধর্ম; তেমনই আছে ঔপনিবেশিকতা। আর এই শব্দটির সঙ্গে জুড়ে আছে আরও দুটি শব্দ— পরিব্রাজক এবং বাণিজ্য। নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশা আমাদের অনেককেই তাড়িত করে। সেটা যদি নতুন কোনো দেশ হয় তাহলে তো কথাই নেই। সেই দেশের সন্ধানেই একসময় কত মানুষ জাহাজে করে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কেউ কেউ পেরেছেন, কেউ আবার পারেননি। জাহাজ সমেত হারিয়ে গেছেন গভীর সমুদ্রে। এই মানুষগুলোর মধ্যেই ছিলেন একজন। নাম তাঁর ক্রিস্টোফার কলম্বাস। বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম কিংবদন্তি চরিত্র হয়ে থেকে গেছেন ইনি। তাঁর যাত্রার আগের কাহিনি, যাত্রার সময়ের কাহিনি রীতিমতো মিথ হয়ে গেছে। যেতে চেয়েছিলেন এক জায়গায়, আবিষ্কার করলেন অন্য একটা দেশ, অন্য একটি রাস্তা। কিন্তু তাই বলে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের গুরুত্ব কমে যাবে নাকি!
কিন্তু আমাদের দেখা, জানার বাইরেও একটা বড়ো জগত আছে। অনেক কিছু সেখানে গোপন থাকে। ওই যে, আগে বলা হল না ইতিহাসের ভেতরের নানা অধ্যায়, স্তরের কথা। অনেক স্তরের ভেতরেও থাকে এমন কিছু স্তর, যার কথা আগে কেউ জানত না। অন্ধকারে রয়ে যায় সেগুলো। তীক্ষ্ণ গোয়েন্দার চোখ নিয়ে সেগুলো খোঁজেন ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিকরা। এরকম অনেক ক্ষেত্র আমরা দেখেছি, হয়ত ভবিষ্যতেও সামনে আসবে এরকম আরও অনেক তথ্য ও তত্ত্ব। কলম্বাসের সঙ্গেও কি জুড়ে আছে সেরকমই কিছু? এমনই প্রশ্ন নানা সময় উঠে এসেছে। ওই যে বলা হল, স্তরের ভেতরেও স্তর…
এবার আসল কথায় আসা যাক। কলম্বাসের অভিযান, তার আগের পরিস্থিতি এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে (যাকে ভুল করে ভারত ভেবেছিলেন তিনি) তাঁর কার্যকলাপ ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথাই শোনা যায়। সেই সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন সামনে চলে আসে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের পূর্ব পরিচয় কী? তিনি কোথাকার বাসিন্দা? তাঁদের পূর্বপুরুষের আসল পরিচয় কী? এই প্রশ্নের বেশ কিছু সহজ উত্তর হয়। প্রথমত, তিনি ইতালির বাসিন্দা। বেশ কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ইতালির লিগুরিয়া প্রদেশে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। নিজের চিঠি এবং নানা লেখায় সেই কথাই উল্লেখ করেছেন স্বয়ং কলম্বাস। বিশেষ করে জেনোয়ার কথা। তাঁর বাবা ডোমেনিক কলম্বো ছিলেন একজন উল বিক্রেতা। সার্বিকভাবে, খুব সাধারণ পরিবার থেকেই উঠে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু সত্যিই কি তাই? হ্যাঁ, এই প্রশ্নচিহ্নই তুলে ধরছেন বেশ কিছু ঐতিহাসিক। গোয়েন্দার দৃষ্টি দিয়ে সমস্ত কিছু কাঁটাছেঁড়া করে দেখে নিতে চাইছেন তাঁরা।
এই ঐতিহাসিকদের মতে, কলম্বাসের জন্ম এবং তাঁর পরিবারের উৎস ইতালিতে নয়; পর্তুগালে। সেই পর্তুগাল, যেখান থেকে তিনটে জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। স্বয়ং পর্তুগালের রানির সমর্থন ছিল তাঁর প্রতি। এই দেশটির প্রতি এত টান কেন কলম্বাসের? এই প্রসঙ্গে কথা বলতে আরও একটা ঘটনার দিকে নজর দিয়েছেন ঐতিহাসিকরা। কলম্বাসের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল এক পর্তুগিজ মহিলার, নাম ফিলিপা মোনিজ পেরেস্তেলো। যার পরিবার সেই সময় ছিল যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানদের সাধারণ লোকের সঙ্গে বিয়ে হত না। বিদেশি হলেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। তাহলে কীভাবে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মতো একজন বিদেশি ইতালীয়, অতি সাধারণ লোকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হল? বলা ভালো, কলম্বাসের অভিযানের আগেই ঘটেছিল এই ঘটনা। তাহলে কি কলম্বাস পর্তুগিজ ছিলেন; এবং তাঁর আসল পূর্বপুরুষরা সেখানকার সম্ভ্রান্ত কেউ?
আরও পড়ুন
ব্যারাকপুরের নীলগঞ্জে হত্যা করা হয়েছিল ৩০০০ আজাদ হিন্দ সৈন্যকে, ইতিহাসের ‘অজানা’ অধ্যায়
২০১২ সালে ফার্নান্দো ব্রাঙ্কো নামের একজন অধ্যাপক এই প্রশ্নটিই তুলেছিলেন। অবশ্য তার সঙ্গে আরও একটি মারাত্মক দিকও সামনে নিয়ে আসেন। এই প্রসঙ্গে চলে আসবে আরও একজনের নাম— পেদ্রো আতাইদে। ইনিও সম্ভ্রান্ত পর্তুগিজ বংশের সন্তান ছিলেন। এঁর পরিবারের সঙ্গে পর্তুগিজ রাজবংশের সংঘাত শুরু হয়। ১৪৭৬ সালে একটি নৌযুদ্ধে তিনি মারা যান। এমনটাই মনে করা হয়। কিন্তু ব্রাঙ্কো’র মতে, হয়তো তিনি মারা যাননি; আহত হয়ে থাকতে পারেন। যদি পর্তুগালে ফিরে যেতেন তাহলে তাঁর জীবনের সংশয় তৈরি হত। সেজন্য নিজের নাম এবং পরিচিতি বদলে তিনি পর্তুগালে আসেন। সালটা খেয়াল করেছেন? একই সালে কলম্বাসও পর্তুগালে প্রবেশ করেন (তাঁর ছেলে ফার্নান্দো কলম্বাসের তথ্য অনুযায়ী)। তাহলে কি এই পেদ্রো আতাইদে এবং কলম্বাসের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে? অধ্যাপক ব্রাঙ্কোর মতে, হতেও পারে যে এই দুজনই একই ব্যক্তি!
হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন। এর স্বপক্ষে নানা প্রমাণও দিয়েছেন তিনি। কিছু প্রসঙ্গ তো আগের কথাতেই এসে গেল। এছাড়াও লক্ষণীয়, কলম্বাস তাঁর সমস্ত চিঠি লিখেছেন স্প্যানিশে; যেখানে পর্তুগিজ শব্দেরও প্রয়োগ আছে। অথচ তিনি ইতালীয়! ইতিহাসের দিকে তাকালে আরও একটি তথ্য দেখা যায়। ১৪৮৫-এর আগে পর্তুগালে কলম্বাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো উল্লেখই নেই কোথাও। অথচ তাঁর নিজের ছেলে বলেছেন ১৪৭৬-এ কলম্বাস পর্তুগালে আসেন। তাহলে কি সমস্ত তথ্য মুছে ফেলা হয়েছিল? নাকি কলম্বাস নাম পরিবর্তন করেছিলেন? সেই সময়ের তথ্য দেখলে একটি নাম সামনে আসবে— পেদ্রো কুলন। স্প্যানিশ কোর্টে কলম্বাসকে এই নামেই ডাকা হয়েছিল। ক্রিস্টোফার কলম্বাস, পেদ্রো কুলন এবং পেদ্রো আতাইদে— এঁরা কি একই ব্যক্তি, নাকি আলাদা কেউ? প্রশ্ন উঠছে জোরালোভাবে…
আরও পড়ুন
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস ও ‘কপালকুণ্ডলার মন্দির’ – মিথ ও ইতিহাসের সহাবস্থান মেদিনীপুরে
আসল রহস্য জানতে ডিএনএ টেস্টের ব্যবস্থাও করা হয়। ফার্নান্দো কলম্বাসের সঙ্গে পেদ্রো আতাইদে’র ভাই আন্তোনিয়’র ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হবে। ২০১৮ সালে দেহাংশ থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়। আশা করা যাচ্ছে, ২০২১ সালেই রিপোর্ট সামনে আসবে। এখন সেইদিকে তাকিয়ে আছেন ঐতিহাসিকরা।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
স্যালুট না জানানো এক বিষণ্ণ বাবা আর ইতিহাস হয়ে যাওয়া সেই ছবির গল্প