আজ থেকে বহু বছর আগের কথা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি তখনও এত জটিল হয়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ দ্বীপের মধ্যে পাশাপাশি অবস্থান করত দুটো দেশ, ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড। আজও যেমন করে। তবে দুই দেশের কোনো সুস্পষ্ট সীমানা ছিল না। নানা সময় এক দেশের সেনাবাহিনী ঢুকে পড়ত অন্য দেশে। কিন্তু তখনও পরিত্যক্ত ছিল মাঝের কিছুটা অঞ্চল। এস্ক নদীর ধারে সংকীর্ণ এই অঞ্চলে পা রাখত না কোনো দেশের সৈন্যই। দুই দেশের সবচেয়ে প্রাচীন সীমানা বোধহয় এই নো-ম্যানস ল্যান্ড।
এস্ক নদীর দুধারে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত এই এলাকা ১৩ মাইল দীর্ঘ এবং ৮ মাইল প্রশস্ত। এই সীমানা অঞ্চলে বাস করত এক প্রাচীন দস্যু সম্প্রদায়। তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল বর্ডার রাইভার্স। এই দুর্ধর্ষ ডাকাতরা মাঝেমাঝেই দু’দেশে ঢুকে পড়ে লুটতরাজ চালাত। আবার নিজেদের মধ্যেও এক দস্যু অন্য দস্যুর সম্পদ চুরি করে নিত। আর তাদের এলাকার উপর দিয়ে কেউ গেলে তো আর দেখতেই হত না। ফলে কোনো দেশের রাজাই এই অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সাহস পেত না। ত্রয়োদশ শতক নাগাদ দুই দেশের আইনেই বলা হয়, এই অঞ্চলের উপর তাদের কোনো শাসন নেই। ফলে দস্যুরাও নির্বিঘ্নে এখানে নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ দ্বীপের মধ্যে তৈরি হয় আরেকটি দেশ।
এভাবেই ক্রমশ দিন কাটছিল। বর্ডার রাইভার্স সম্প্রদায়ের একেকজন দস্যুর কাহিনি হয়ে উঠেছিল কিংবদন্তি। তবে সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজনে ক্রমশ বদলাতে থাকে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের রাজনৈতিক সম্পর্ক। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম স্টুয়ার্ট এবং স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস নিজেদের দেশের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সীমানা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ফলে বর্ডার রাইভার্সদের দমন করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ততদিনে সেখানে রাজত্ব শুরু করেছেন এক দুর্ধর্ষ ডাকাত আলেকজান্ডার আর্মস্ট্রং। একটি বিশাল দুর্গ বানিয়ে সেখানে অবস্থান করেন তিনি। তবে দুই দেশের মিলিত শক্তির কাছে পরাজিত হলেন তিনি। অবশেষে ১৬১০ সালে আলেকজান্ডার এবং তাঁর ১১ জন পুত্রের ফাঁসি দেওয়া হয়।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর একটু বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল বর্ডার রাইভার্সরা। একের পর এক বহু দস্যুর বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাদের ঐক্যবদ্ধ রাজত্ব ভেঙে পড়েছিল সেদিনই। তবে তারপরেও ইংল্যান্ড বা স্কটল্যান্ড কেউই এই অঞ্চলের উপর রাজত্ব কায়েম করেনি। এই এলাকা এখনও একটি নো-ম্যানস ল্যান্ড। এমনকি একশো বছর আগেও মানুষ এই অঞ্চলের উপর দিয়ে যেতে ভয় পেতেন। দস্যুরা তখনও প্রায়ই লুটতরাজ চালাত। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই হঠাৎ তারা কোথায় হারিয়ে যায়, তার কোনো সঠিক উত্তর জানা নেই।
তবে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের মাঝে এই সীমানা অঞ্চলে এখনও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের অসংখ্য সাক্ষী। উঁচু পাহাড়ের মাঝে এই অঞ্চলের নির্মল প্রকৃতির মধ্যে ছুটি কাটাতে ভিড় জমান বহু পর্যটক। আর আছে আলেকজান্ডার আর্মস্ট্রং-এর সেই দুর্গ। আজ সেটা একটা মিউজিয়াম। সেখানে কাচের শো-কেসে সাজানো আছে কয়েকশো বছরের ইতিহাসের নানা উপাদান। আজ সেই দস্যুদলের স্মৃতিটুকুই থেকে গিয়েছে। তবু এখনও যেন কীসের এক আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়। দুই দেশের সীমানার বাইরে এই নো-ম্যানস ল্যান্ড যেন ব্রিটিশ দ্বীপের অন্য একটি দেশ।
Powered by Froala Editor