‘স্কাল্পটিং ইন টাইম’ বইতে আন্দ্রেই তারকভস্কি লিখছেন, ‘...যেমন ধরুন, বার্গম্যান নিজের ছবিতে শব্দ ব্যবহার করেন ন্যাচারেলিস্টিক ভাবে। ফাঁকা করিডোরে জুতোর আওয়াজ, ঘড়ির ঘন্টার শব্দ, পোশাকের খসখসানি, এ সব কিছুই তিনি শোনান স্বাভাবিকের চেয়ে মাত্রা চড়িয়ে – কখনো আবার একটা শব্দকেই বেশি উঁচুতে তুলে। এবং ঐ একটি শব্দ বাদে তখন আর কিচ্ছুটি রাখেন না, বাদ দেন আশপাশের সমস্ত আওয়াজই।’
ব্যাপারটা কীরকম? সেটা বোঝাতেই ইঙ্গমার বার্গম্যানের ১৯৬৩ সালের ছবি ‘উইন্টার লাইট’-এর উল্লেখ করছেন তিনি। একটি দৃশ্য ছিল, যেখানে আত্মঘাতী জোনাসের শব খতিয়ে দেখছে পুলিশ, দূর থেকে কয়েকটি মানুষ দেখা যাচ্ছে এবং তাদেরই পাশ দিয়ে বইছে এক খরস্রোত নদী।
...‘লং আর মিডিয়াম শটে তোলা দৃশ্যে একটানা একটাই আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে - সেই নদীর কুলকুল শব্দ। তাছাড়া কাপড়ের কোনও খসখস, পায়ের শব্দ, কথাবার্তার আওয়াজ – কিচ্ছু না।’
শব্দকে একটি মাত্রায় রেখে প্রয়োগ করলে তার ফল দাঁড়ায় মারাত্মক, অনেক বেশি ব্যঞ্জনাময় আর জোরালো – জানাচ্ছেন তারকোভস্কি। শব্দ নিয়ে নিজের উত্তেজনা তিনি লুকিয়ে রাখেন না, ...‘ভাবুন, একটা পাত্রে জল ঢালার থেকে দুধ ঢালার শব্দ কত আলাদা! হাওয়ার শব্দ, কিংবা আগুনের শব্দ! শুধু আগুনকেই ধরুন না। কখনো তা পুরো একটা সিম্ফোনি হয়ে যায়, কখনো আবার সুরেলা বাঁশির মতো।’
আরও পড়ুন
ভারত-চিন যুদ্ধ, সেন্সর বোর্ডের কোপে মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’
‘... আমার এখন মনে হয় না, ছবি করতে মিউজিকের আদৌ দরকার আছে। যদিও আমি এখনও অবধি মিউজিক একেবারে বাদ দিয়ে কোনও ছবি করিনি, কিন্তু তাও বলব, ‘স্টকার’ বা ‘নস্টালজিয়া’-র মতো ছবিগুলোয় আমি ঐ-রকম মিউজিক রহিত ছবির দিকে যেতে চেয়েছি,’ লিখছেন আন্দ্রেই।
আরও পড়ুন
‘ফাইনালি যখন কাজটা আমিই করছি, আমিই আবহ সঙ্গীত রচনা করি’; সুরের জাদুর সেই শুরু
‘উইন্টার লাইট’-এ যেমন দেখেছি, ছবিতে ‘শব্দ’ ব্যবহারের এমন তরো চমৎকার উদাহরণ আছে ‘নস্টালজিয়া’ (১৯৮৩) তেও।
আরও পড়ুন
শঙ্কু থেকে কিশোর গল্প, বারবার সেই অজানা দেশ ‘ডুংলুং ডো’ খুঁজেছেন সত্যজিৎ
শীর্ষ চরিত্র ডোমিনিক দীর্ঘদিন তার বউ বাচ্চাকে লুকিয়ে রেখেছিল বাড়িতে। রঙ চলে গিয়ে ভেসে ওঠে সাদা কালো ইমেজ, তাদের ঘর থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে। পুলিশে আর লোকে ছয়লাপ বাড়ির সামনেটায়। কিন্তু কোনও গুঞ্জন নয়, কেবল একটা চেরাইয়ের শব্দই পাচ্ছি আমরা। ডোমিনিকের বউ পুলিশের পা জড়িয়ে ধরছে, উল্টোনো দুধের বোতল থেকে দুধ গড়াচ্ছে স্লো মোশনে। ...অথচ তার কান্নার শব্দ নেই, দুধ গড়িয়ে পড়াও না। চারপাশের কোনও শব্দই রাখেন নি তারকোভস্কি। কেবলই করাত-চেরাই শব্দ – পেডাল ক’রে চাকা ঘুরিয়ে অবিকল যে শব্দ তুলে চেরাই করে ডোমিনিক।
আরও পড়ুন
'পথের পাঁচালী'র সেটে আলাপ, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বললেন সৌমেন্দু রায়
শিশু পুত্রের পিছুপিছু সে এগিয়ে যাচ্ছে খাদের সীমা অবধি, যেখানে পৌঁছে তারা দেখতে পায় আধুনিক শহর শুরু হচ্ছে। একটা পিচঢাকা ঘোরানো রাস্তা চলে গেছে পুরোনো সভ্যতার মধ্যিখান দিয়ে। করাত চেরাইয়ের শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন
সর্বজয়ার কান্নায় রবিশঙ্করের সুর, মুগ্ধ সত্যজিৎ বদল এনেছিলেন যে দৃশ্যে
ছেলে তার নিষ্পাপ মুখ ফেরাচ্ছে ক্যামেরার দিকে, শুধোচ্ছে, ‘বাবা, এই কি পৃথিবীর শেষ?’ –এই প্রথম আমরা কথা শুনতে পাচ্ছি সিকোয়েন্সটায়।
এমন উদাহরণ আর কোথায় কোথায় আছে? - ভাবতে গিয়ে বিদেশি ছবিই খুঁজতে হচ্ছিল প্রথমে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ব্লান্ডার হয়ে যাচ্ছে। জিনিসটা আমাদের দেশেই আছে, আমাদের সর্ব প্রধান ছবিতেই।
‘পথের পাঁচালি’-র শ্রেষ্ঠ একটি সিকোয়েন্স, যেখানে ইন্দির ঠাকরুনের দেহ অপু-দুর্গা আবিষ্কার করছে বাঁশবনে। ইমেজ অতুলনীয়, কিন্তু তার আবহে কী ছিল?
দুর্গা নেড়ে দেখছে পিসির মাথা, যেটা ধপ ক’রে পড়ে যাবে মাটির ওপর। দুর্গার অবিশ্বাসী মুখের ক্লোজ আপ। পুরোনো কাঠের মচমচ করার শব্দ, বাঁশের মড়মড়ানি। হাওয়া বইছে।
পুরো সিকোয়েন্সই চাপা জমাট নিঃশব্দ দিয়ে মুড়ে রাখা, প্রায় যেন খেয়ালই হচ্ছে না এমন কিছু ক্ষীণ আওয়াজ।
মনে করুন ‘স্টকার’ ছবির একটি দৃশ্য । বিজ্ঞানী, অধ্যাপক আর গাইড ট্রলিতে বসিয়ে যাচ্ছে নিষিদ্ধ অঞ্চলের দিকে। আবহে কেবল কিছু চাপা ইলেকট্রনিক শব্দ রেখেছেন তারকোভস্কি। তাঁর কথায়, ‘শব্দগুলো শুনলে দর্শকের মনে হবে যেন আসলে ছবি থেকে শব্দটা আসছে না, তাদেরই মাথার মধ্যে হচ্ছে।’ ঐ বিশেষ হ্যালুসিনেশন তৈরি করতে অনেক খেটেছিলেন নির্মাতারা। ...আমরা এখন বুঝি, কৃত্রিম শব্দের বদলে ওখানে সংগীত রাখলে ব্যাপারটা আদৌ অত ছমছমে হয়ে উঠত না।
ইন্দিরের মৃতদেহ আবিষ্কার খুবই আকস্মিক ও খানিক নাটকীয়ও বটে। কিন্তু শব্দে রাখা হয় অসম্ভব সংযম। বালক-বালিকার প্রথম মৃত্যু দেখার আতঙ্ক বা শিরশিরানি সবই ঐ একটি শব্দে বেরিয়ে আসে। আমাদের মাথার মধ্যেই যেন হচ্ছে ঐ অনুরণন! ...দুর্গা দেহটি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, এবার ছুট দিচ্ছে।
তার পা লেগে পিসির জল খাওয়ার ঘটি উলটে গেল, সেটি গড়িয়ে যাওয়ার খনখনে সুরেলা আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
ঘটি এসে পড়েছে জলে, বিগ ক্লোজ আপ। জল মাড়িয়ে ভাই বোন ছুটে যাচ্ছে, পায়ের গোড়ালিটুকু দেখছি।
ইন্দির ঠাকরুনের হাড়সর্বস্ব মুখের ক্লোজ আপ নেওয়া হয়, একই সময়ে তার গলায় সেই পুরাতন গানটি আমরা শুনি (‘হরি দিন তো গেল’)। রাতের ঝিঁঝিঁ ডাকের সঙ্গে গানটি এই দিনের বেলায় ক্ষীণ স্বরে বাজতে থাকে। ইন্দির ঠাকরুনের দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখনও। দুর্গা দাওয়ায় বসে ফোঁপাচ্ছে, তখনও একই গান, পুকুরের ধারে হরিহর আর সর্বজয়াকে ধরছে ক্যামেরা, গানটি চলছে। আর কোনও শব্দ নেই। - ছোট্ট পরিবারটির শোক ও অপরাধবোধ আর কিছুতে এত ভালো ফুটত না।
এখানেও একটি মাত্রায় আছে শব্দ, পরিপার্শ্বের সমস্ত শব্দকে বাতিল ক’রে ঐ শব্দটিকেই উঁচু ক’রে দিতে তার অভিঘাত দাঁড়ায় ভয়াবহ।
...বলা যায় ঋত্বিক ঘটকের ভাষায়, ‘পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মতো।’ ...‘অপরাজিত’ ছবিতে ট্রেনের জানলা দিয়ে যখন গ্রামবাংলার ল্যান্ডস্কেপ প্রথমবার দেখা যায় এবং বেজে ওঠে আগের ছবি ‘পথের পাঁচালি’র চিরচেনা থিম ট্র্যাক - ‘একমাত্র সত্যজিৎ রায়’ লেখাটিতে ঠিক তর্জনী দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দেন ঋত্বিক, ‘ঐ সুরটি নিশ্চিন্দিপুর আর আমাদের গ্রামবাংলার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। ...বাংলা দেশ তার সমস্ত শ্যামলিমা নিয়ে আছড়ে পড়ে আমাদের বুকের ওপরে।’
Powered by Froala Editor