লাইট ইন ব্যাবিলন ও কাঁটাতার পেরোনো গান

তাদের গান প্রথম শুনেছিলাম বেশকিছু বছর আগে। ছিপছিপে দীর্ঘাঙ্গী এক মেয়ে সমস্ত শরীর দিয়ে গাইছে। খোলা চুল মুখের চারপাশে। গানের দাপটে ফুলে উঠছে গলার শিরা। গানের ভাষা বুঝছি না। শুধু লেখা দেখলাম, হিব্রু ভাষার গান। হিব্রু গান! আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। সে ভাষা আমার বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। দেখার দিকেই চোখ যাচ্ছিল বেশি। কিন্তু আশ্চর্য! দেখতে দেখতেই যেন কত-কী বুঝে ফেলা যায়। মেয়েটি গাইছে প্রাণপণ। সঙ্গে তাল রাখছে যন্ত্রে। পাশে বসে সন্তুর বাজাচ্ছে একজন, আরেকজন গিটার। কোনো এক রাস্তার ফুটপাথে বসেছে এই গানের আসর। চারপাশে কেবলি ভিড় বাড়ে। ব্যান্ডের নাম লাইট ইন ব্যাবিলন। তাদের গানের যাত্রা শুরু হয়েছিল রাস্তাতেই। তারপর গোটা বিশ্বেই যাতায়াতের পথ খুলে গিয়েছে।

একদশক পথ হেঁটে ফেলল লাইট ইন ব্যাবিলন। ইস্তাম্বুলের ব্যস্ত রাস্তা ইস্তিকলাল এভিনিউ।  দোকানপাট বাজার, ক্যাফে, অট্টোমান আমলের বিশাল অট্টালিকা আর ব্যস্ততা ইস্তাম্বুলের এই রাস্তার বৈশিষ্ট্য। কেউ কাউকে দেখে হাসে না, অন্য কোনো দিকে মুখ ফেরায় না। শুধু নিজের নিজের গন্তব্যের দিকে দৌড়ে যায়। সেই রাস্তায় নিজেদের গান নিয়ে হাজির হয়েছিল লাইট ইন ব্যাবিলন। লোকজন তাদের চিরাচরিত দৌড়াদৌড়ি ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কোথাও এই দাঁড়িয়ে পড়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে 'লাইট ইন ব্যাবিলন' নামের গুরুত্বটিও।

নিজেদের পরিচয় বলতে গিয়ে মিশাল এলিয়া কামাল জানায় সেকথা। যার কথা দিয়ে শুরু হয়েছে এই লেখা। তাঁর মতে, ব্যাবিলন একটা সিস্টেমের নাম। আর সেই সিস্টেমে থাকতে থাকতে লোকে ভুলে যায়, সিস্টেমের বাইরের জগৎটার দিকে তাকাতে। সেই "এর বাইরেও জগৎ আছে, তোমরা জানো না..."র গল্প। তা সেখানে যখন কোনো শিল্প আসে, তা আলোর মতো আসে।  আর তখনই নাকি মানুষ শিকল কেটে বেরোয়, নিজেকে  আবিষ্কার করে। সেই আলো হয়ে উঠতে চায় এই ব্যান্ডটি। তারা গোটা বিশ্বেই সে আলো ছড়াতে চায়।  লাইট ইন ব্যাবিলনের গানের কথা হিব্রু। তার লেখক মিশাল এলিয়া নিজেই।  কিন্তু শুধু হিব্রু  দিয়ে কীভাবেই বা এমন স্বপ্ন দেখে তারা? মিশাল বলে, ব্যাবেল টাওয়ারের গল্প। যে টাওয়ার ভেঙে দিয়েছিলেন ঈশ্বর স্বয়ং। আর তারপর থেকেই মানুষে-মানুষে এত দূরত্ব। মিশালের বক্তব্য, আজও একটা ভাষা প্রতিটি মানুষ বোঝে, তা হল অনুভূতির ভাষা। সঙ্গীত মানুষের সেই অন্তর্লীন অনুভূতি। লাইট ইন ব্যাবিলন চায়, সে অনুভূতির ভাষায় গান গাইতে। হয়তো একারণেই পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই ব্যান্ডের অসংখ্য শ্রোতা। তারা নানান ভাষাভাষী মানুষ।  

ব্যান্ডের গিটার-বাদক জুলিয়েন ডেমারকিউ ফরাসি, সন্তুর-বাদক মেতেহান সিফ্টসি তুরস্কের মানুষ। আর মিশাল এলিয়া কামালের শিকড় বিছিয়ে আছে ইজরায়েল থেকে ইরানে। এছাড়া তাদের দলে দলে রয়েছেন আরো দুজন শিল্পী। একজন স্কটিশ, আরেকজন ইরানের।

আরও পড়ুন
‘নিগার্স’ বদলে ‘ডার্কি’ ব্যবহার করলেন পল রোবসন, কালো মানুষের গান আছড়ে পড়ল সারা বিশ্বে

এই বৈচিত্র্য কে ধারণ করে চলছে এই ব্যান্ড এক দশক ধরে। তারা নিজেদের এই বিশাল পৃথিবীর বাসিন্দা বলে দাবি করে, তাদের ভাষার নাম সঙ্গীত। হিব্রু ভাষায় মূলত লোকসঙ্গীতের আঙ্গিকেই গান বাঁধে তারা। সে গানে প্রেম আছে, প্রার্থনা আছে। কাঁটাতার পেরিয়ে তারা গানে ধরা পড়ে ভারতবর্ষও। হৃষিকেশের গঙ্গার ছবি ফুটে ওঠে সেখানে। আর এভাবেই মানুষে মানুষে বিভেদ ঘোঁচানোর কাজ করে চলে, আলো ফেলে চলে - "লাইট ইন ব্যাবিলন"।

আরও পড়ুন
সত্যিই মৃত, নাকি এফবিআই এজেন্ট হয়ে আত্মগোপন? এলভিস প্রেসলির মৃত্যু নিয়ে রহস্য

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
অন্যদের বারণ সত্ত্বেও উড়ান, মাত্র ৫৩ বছরেই বিমান-দুর্ঘটনায় মৃত জন ডেনভার