১৭৯৫ সালে কলকাতায় প্রথম ‘থিয়েটার’-এর অভিনয় হয় রাশিয়ান লেবেদেফের হাতে। চক্রান্তের শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত অবস্থায় দেশে ফিরে যান তিনি। শিশিরকুমার ভাদুড়ি দেনার দায়ে ‘দেউলিয়া’ ঘোষণা করেছিলেন নিজেকে। অমরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো ধনী পরিবারের বিখ্যাত সন্তানও থিয়েটারে এসে হারাতে বসেছিলেন সর্বস্ব। বাংলা থিয়েটারের এই সর্বগ্রাসী ক্ষুধার বলি হয়েছেন আরো অনেকেই। সেই তালিকায় এক বিস্মৃতপ্রায় নাম রাজকৃষ্ণ রায় (Rajkrishna Roy)।
উনিশ শতকের শেষের দিকে রাজকৃষ্ণ রায় ছিলেন বীণা থিয়েটারের মালিক। জীবনের প্রথমলগ্নে তাঁর খ্যাতি ছিল কবি হিসেবে। নিজের একটা ছাপাখানাও ছিল। সেখান থেকে প্রকাশ করতেন ‘বীণা’ নামের একটি পত্রিকা। বিপদ ঘনিয়ে এল থিয়েটারের মালিক হয়ে। আর্য নাট্যসমাজে নিজের নাটক ‘প্রহ্লাদ চরিত্র’-এ নিতান্তই শখের বশে অভিনয় করেছিলেন তিনি। যার প্রশংসা হয় কিছু ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্রে। মাহেশ ও কলকাতায় আরো কয়েকটি নাটকে অংশগ্রহণ করে চেপে বসে নিজের থিয়েটারের শখ।
কলকাতার থিয়েটারে তখন চালু হয়ে গেছে অভিনেত্রী নিয়োগের চল। সমালোচনা হলেও, দর্শক সমাদর পেয়েছিল এই প্রথা। রাজকৃষ্ণ রায় ছিলেন অভিনেত্রী নিয়োগের বিরোধী। নীতিবাগীশ মহল থেকে সমর্থনের কারণে সময়ের উলটো দিকে চলার জেদ আরো দৃঢ় হয়ে বসে। এদিকে আর্থিক সংগতিও নেই খুব বেশি। ফলে ৩৮ নম্বর মেছুয়াবাজারে ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বীণা থিয়েটারে বাহ্যিক চাকচিক্য ছিল না একেবারেই। ১০ ডিসেম্বর তাঁরই লেখা ‘চন্দ্রহাস’ নাটক দিয়ে শুরু হল পথচলা। আর্য নাট্যসমাজের পুরুষরাই অংশগ্রহণ করলেন নারীচরিত্রে। রক্ষণশীল সমাজের প্রশংসা তো ছিলই, সার্বিক অভিনয় নৈপুণ্যের জন্য ‘ইন্ডিয়ান মিরর’-এর পত্রিকাও উৎসাহ দিয়েছিল তাঁর প্রচেষ্টায়।
কিন্তু প্রশংসা দিয়ে পেট ভরে না। কলকাতার অন্য রঙ্গালয়গুলি যখন সাফল্যের শিখরে, তখন বীণা থিয়েটার অভিনয় করে চলেছে দর্শকশূন্য প্রেক্ষাগৃহে। অভিনেতারা সকলেই অবৈতনিক, ধনী ব্যক্তিরাও সাহায্য করলেন অর্থ দিয়ে। তাতেও চালানো গেল না থিয়েটার। গিরিশচন্দ্র পরে লিখেছিলেন, “স্বর্গীয় রাজকৃষ্ণ রায় বালক লইয়া অভিনয় করতে গিয়া বহু আয়াস-সঞ্চিত সম্পত্তি বিনাশ করিয়াছিলেন।” ঋণগ্রস্ত রাজকৃষ্ণ বাঁচার আশায় ভাড়া দিতে বাধ্য হলেন স্বপ্নের বীণা থিয়েটার।
আরও পড়ুন
থিয়েটারের জন্য চড়া সুদে টাকা ধার, গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল ‘দেউলিয়া’ শিশির ভাদুড়িকে
পরের এক বছর দুটি গোষ্ঠী সেখানে অভিনয় চালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ১৮৮৮ সালে বীণাতে শুরু হল রাজকৃষ্ণের দ্বিতীয় দফার নাট্যপ্রচেষ্টা। আগের ভুল এবার করলেন না আর। সমস্ত আদর্শ বর্জন করে কুড়ি টাকা বেতনে তিনকড়ি দাসীকে নিয়ে এলেন তিনি। যে পক্ষ এতদিন তাঁকে সমর্থন জানিয়ে এসেছিল, তারাই এবার হয়ে উঠল বিরূপ। ‘আদর্শত্যাগ’-এর জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হল তাঁকে। অর্থাৎ দুই দিকই হারালেন রাজকৃষ্ণ। ভালো অভিনয় সত্ত্বেও ভরে উঠল না প্রেক্ষাগৃহ। ক্রমে আরো ধারদেনা গ্রাস করতে থাকল তাঁকে।
আরও পড়ুন
প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও বাঙালির তৈরি প্রথম থিয়েটারের গল্প
অবশ্য চেষ্টার কসুর করেননি তিনি। মাইক্রোফোনে নেপথ্যে গান চালানোর অভিনব ব্যবস্থা করলেন, টিকিটের দাম কমিয়ে ‘চিপ থিয়েটার’ প্রথা নিয়ে এলেন। মঞ্চটিকে সাজিয়ে তুললেন আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। কিন্তু বীণা থিয়েটার নিয়ে মানুষের পূর্বের ধারণা এবং বর্তমান সমালোচনায় দুরবস্থার চিত্রটা বদলাল না কোনোভাবেই। বরং ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়লেন আরো। ১৮৯০ সালে পত্রিকা মারফৎ সাহায্য চাইলেন সকল স্তরের মানুষের কাছে। সাড়া মিলল না। বীণা থিয়েটারকে ফের ভাড়া দিয়ে অন্য থিয়েটারগুলিতে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে পড়লেন তিনি। স্ত্রী-কন্যার সমস্ত অলংকার বিক্রি করে দিয়েও ঋণের বোঝা কমেনি। অবশেষে বিক্রি করতে বাধ্য হলেন বীণা থিয়েটার।
১৮৯২-এ প্রিয়নাথ চট্টোপাধ্যায় ‘ভিক্টোরিয়া অপেরা হাউস’ নাম দিয়ে সেখানে শুরু করলেন এক নতুন প্রচেষ্টা। এই থিয়েটারে অভিনয় করত শুধু মহিলারা। ইতিহাসের কী অদ্ভুত পরিহাস! মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে পুরুষদের বদলে পুরো মঞ্চটাই দখল করে নিল মহিলারা। অবশ্য এই পদ্ধতিও চলেনি বেশিদিন। অবশেষে ১৮৯৪ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় প্রয়াণ ঘটে রাজকৃষ্ণ রায়ের। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে আরেকটি কারণে স্মরণীয় তিনি। মধুসূদন দত্তের অমিত্রাক্ষর ছন্দের আদর্শ থেকে জন্ম হয়েছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘গৈরিশ ছন্দ’-এর। ১৮৮১-তে ‘রাবণবধ’ নাটকে দেখা যায় তার প্রয়োগ। তার আগেই ‘হরধনুভঙ্গ’ নাটকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ভেঙে প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন রাজকৃষ্ণ রায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলার ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে গেছে তাঁর নাম। থিয়েটারের টাকাপয়সার গোলকধাঁধায় যিনি হারিয়েছিলেন নিজের আদর্শ আর সমস্ত সম্পত্তি। সততা থাকলেও চিনতে পারেননি সময়ের দাবি। আর যখন বুঝেছিলেন, তখন দেরি হয়ে গেছিল অনেকটাই।
Powered by Froala Editor