স্বামী বিবেকানন্দের (Swami Vivekananda) সঙ্গে যখন মার্গারেট নোবেলের প্রথম দেখা হয়, তখন তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। একই সময়ে জন্মভূমি আয়ারল্যান্ডে চলছে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিপ্লবের প্রস্তুতি। পিতা পার্নেলের প্রভাবে তিনি সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন সেই কাজে। এরপর আসে সশস্ত্র সংগ্রামের পালা। বিপ্লবের ভার নিয়ে তিনি আসেন লন্ডনে। আর সেখানেই প্রথম সাক্ষাৎ বিবেকানন্দের সঙ্গে। সেটা ১৮৯৫ সাল। তারপর স্বামীজির দীক্ষা-শিক্ষায় মার্গারেট হয়ে উঠলেন ভারতের ‘ভগিনী’, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘লোকমাতা’। এদেশে এসে জীবনের তেরোটি বছর মানুষের সেবা করে কাটালেন নিবেদিতা (Sister Nivedita)। বহুমুখী তাঁর জীবন, বিস্তৃত তাঁর কর্মপদ্ধতি। আইরিশ বিপ্লবের যে আগুন ধারণ করেছিলেন বুকে, ব্রিটিশশাসিত ভারতের স্বাধীনতার পালেও লাগিয়ে দিলেন সেই সশস্ত্র সংগ্রামের হাওয়া।
১৯০২ সালের ৪ জুলাই প্রয়াণ ঘটে স্বামীজির। তার ঠিক দুসপ্তাহের মাথায় বেলুড় মঠের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে ভবিষ্যতে ভগিনী নিবেদিতার কাজের সমস্ত দায়িত্ব তাঁর নিজের। বেলুড় মঠ কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে তার সঙ্গে যুক্ত নয়। কেন? প্রকাশ্যে কিছু ঘোষণা না করলেও অন্যতম কারণ যে নিবেদিতার রাজনৈতিক সংযোগ, সেটা বুঝতে দেরি হল না। ওকাকুরার সঙ্গে বন্ধুত্ব, ঠাকুরবাড়ির সুরেন ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সর্বোপরি অরবিন্দ ঘোষের (Aurobindo Ghosh) গুপ্ত সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ—নিবেদিতা ভারতের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন বিভিন্ন সময়ে। তার আগে থেকেই কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল স্বামীজির সঙ্গে। সমাজ ও ধর্মসংস্কারের প্রয়োজন অতি অবশ্যই এবং সে পথে তিনি স্বামীজিকেই অনুসরণ করবেন। তবে তার সঙ্গে প্রয়োজন শিক্ষা। পরাধীন দেশের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যস্থায় যা কখনই সম্ভব নয়। একমাত্র স্বাধীনতাই পারে, এই দুর্দশা থেকে দেশকে মুক্ত করতে। ১৯০১ সালে চিঠিতে বন্ধুকে লিখছেন, “আমি কিন্তু একইসঙ্গে রাজনৈতিক প্রয়োজনকেও অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। আমার এখন বিশ্বাস হয়ে উঠেছে, উঠতি ভারতের জন্য, ভারতীয় পুরুষদের জন্য আমার কিছু করার আছে।”
ওকাকুরা ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের সমর্থক। সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে ব্রিটিশমুক্ত করার মহান পরিকল্পনায় আকৃষ্ট হন নিবেদিতাও। কিন্তু অন্য দেশের সাহায্যে মাতৃভক্তিকে স্বাধীন করার মধ্যে কি আত্মশক্তি জাগে? স্বামীজি কিন্তু এই নিয়ে ভেবেছিলেন প্রথম থেকেই। ওকাকুরার আবেগতাড়িত বিপ্লববাদের বাণীতে প্রভাবিত হয়ে নিবেদিতা এই পথ নিলেও, পরে বেছে নেন স্বামীজির ‘মিশন’কেই। কোথাও যেন অভাব অনুভব করছেন তাঁর শরীরী অস্তিত্বের। লিখছেন, “সবকিছুই ব্যর্থ মনে হচ্ছে—কেবল ব্যর্থ নয় সেই বিরাট জীবন। পরিপূর্ণ তাঁর জীবন।” নিবেদিতা ফিরে গেলেন জাতীয়তাবাদী সংগঠনের কাজে। দেশের বিভিন্ন অংশে শোনা গেল তাঁর কণ্ঠের আহ্বান। এর মধ্যে মাদ্রাজের বক্তৃতাগুলি নিয়মিত ছাপা হচ্ছিল সংবাদপত্রে। বেলুড়মঠের সন্ন্যাসীরা অত্যন্ত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন তাতে। কে জানে, প্রতিহিংসাপরায়ণ ইংরেজ সরকারের আঘাত নেমে আসতে পারে এই মঠের উপরেও। নিবেদিতার কাছে রইল দুটি বিকল্প। হয় রাজনীতিহীন জীবন, নতুবা বেলুড়মঠের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংস্রবত্যাগ। দ্বিতীয়টিই বেছে নিলেন তিনি। রাজনীতির সঙ্গে ততদিনে তিনি একাত্ম হয়ে গেছেন। প্রাণত্যাগ ছাড়া সরে আসতে পারবেন না সেই পথ থেকে।
তার আগেই যোগাযোগ হয়েছে অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে। নিবেদিতার ‘কালী দ্য মাদার’ পড়ে তিনি মুগ্ধ। বরোদায় অরবিন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই নিবেদিতা কলকাতার গুপ্ত সমিতিতে যোগদান করেন। বারীন ঘোষের মতে, তিনি তখন বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টার ‘জোয়ান অফ আর্ক’। চরমপন্থী নেতারূপে অরবিন্দের অগ্রগামী। তার সঙ্গে চলছে ধর্মসংক্রান্ত বক্তৃতাসভা। যেখানে ধর্মের থেকে রাজনীতির কথাই বেশি। মেদিনীপুরে একসভায় বক্তৃতা চলাকালীন বাধাদান করে এক রাজকর্মচারী। নিবেদিতার উত্তর, “আপনি আমায় ভয় দেখাবেন না। আমার শিরাতে স্বাধীন জাতির রক্ত এখনও প্রবাহিত। যারা ভয় পায়, আমার বক্তৃতা তাদের জন্য নয়।” সারা জীবন এই বক্তব্যের সত্যতাই প্রমাণ করে গেছেন তিনি। অনুশীলন সমিতিতে নিজের গ্রন্থাগার থেকে দান করেছিলেন প্রায় দেড়শ-টি বই। স্বাধীনতাকামী সাহসী বাঙালি যুবকদের সঙ্গে তলোয়ার খেলতেন, মুগুর ভাঁজতেন, লাঠি ঘোরাতেন। হাত লাগিয়েছিলেন বোমা বাঁধার কাজে। আরেকবার স্থানীয় কয়েকজন ভদ্রমহিলাদের সম্মেলনে গেছিলেন বক্তৃতা দিতে। সভা শেষে নিজে হাতে বন্দুক চালাতে শেখালেন তাদের।
আরও পড়ুন
'সূর্যোদয়' দেখতে চেয়েছিলেন নিবেদিতা, মৃত্যুর পর শুধু অবহেলাই দিল দার্জিলিং!
আলিপুর বোমা মামলার পর অরবিন্দ ঘোষ সম্পূর্ণ সরে আসেন সংগ্রামের পথ থেকে। যদিও পুলিশের তীক্ষ্ণ নজর ছিল তাঁর উপর। তখন নিবেদিতার সাহায্যে চন্দননগরের পথ ধরে পণ্ডিচেরি পাড়ি দেন অরবিন্দ। বাস্তবেই স্বাধীন জাতির রক্ত ছিল তাঁর শরীরে। নাহলে পরাধীন ‘বিদেশ’-কে এভাবে ভালোবাসা যায় না। আরাধ্য গুরু প্রয়াত, পরিত্যক্ত হয়েছেন শেষ আশ্রয় থেকে। তবু লড়ে গেছেন জীবনের আকাঙ্ক্ষায়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা বাক্যই যেন প্রযোজ্য হয় তাঁর সমগ্র কর্মের বর্ণনায়, “ভারতবর্ষকে যাঁরা সত্যিই ভালোবেসেছিলেন, তার মধ্যে নিবেদিতার স্থান সবচেয়ে বড়।”
আরও পড়ুন
জগদীশচন্দ্রের লেখালিখির সম্পাদিকা, বসু বিজ্ঞান মন্দির গড়তেও সাহায্য করেছিলেন নিবেদিতা
ঋণস্বীকার : ভগিনী নিবেদিতা ও বাংলায় বিপ্লববাদ, শ্রীগিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী
নিদেদিতা লোকমাতা, শঙ্করীপ্রসাদ বসু
Powered by Froala Editor