বিজ্ঞানে দেশের প্রথম মহিলা ডক্টরেট অসীমা চট্টোপাধ্যায়, অবদান ছিল মৃগী-ম্যালেরিয়ার ঔষধেও

২০২০ সালের ‘জাতীয় বিজ্ঞান দিবস’-এর মূল থিম ছিল ‘বিজ্ঞানে নারী’। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে আলাদা করে মহিলাদের অবদানের কথা স্মরণ করে নেওয়ার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে থাকে দীর্ঘ বৈষম্যের ইতিহাস। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে হোক, কিংবা তারপরেও বিজ্ঞানসাধনার প্রতিপদে বরাদ্দ থাকত বঞ্চনা। সাধারণ শিক্ষালাভ করতেই যেখানে গঞ্জনা সহ্য করতে হত, সেখানে ‘বিজ্ঞানী’ হয়ে ওঠার পথটা ছিল কাঁটায় ঘেরা। আর সেই পথে চলেই ইতিহাস তৈরি করেছিলেন অসীমা চট্টোপাধ্যায় (Asima Chattopadhyay)। খ্যাতি অর্জন করেছিলেন বিজ্ঞানে ভারতের প্রথম মহিলা ডক্টরেট হিসেবে।

অথচ, স্কটিশ চার্চ কলেজে রসায়ন পড়তে ভর্তি হওয়ার সময় তাঁকেও মুখোমুখি হতে হয় পারিবারিক বাধার। একমাত্র এই কলেজে মেয়েদের রসায়ন পড়ার সুযোগ থাকলেও, তা ছিল ‘কো-এড’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিবারের আপত্তি উপেক্ষা করেই পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। পাশে ছিলেন পিতা ইন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় ও মা কমলা দেবী। মূলত পিতার সূত্রেই বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন অসীমা। গ্রামের পথ দিয়ে চলতে চলতে শেখেন বিভিন্ন ভেষজ গাছপালার নাম ও তাদের গুণাগুণ। ১৯১৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জন্ম অসীমার। বৃত্তিসহ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করেন বেথুন কলেজিয়েট স্কুল থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই ছোটোবেলার গাছপালার জ্ঞানকে নতুন করে গবেষণা করে দেখতে শুরু করেন তিনি। 

১৯৩৬ সালে স্বর্ণপদকসহ শেষ করেন স্নাতকস্তরের পড়াশোনা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করেন জৈব-রসায়ন নিয়ে। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে উচ্চতর গবেষণায় ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৪৪ সালে। ছাত্রীজীবনে পেয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসুদের সান্নিধ্য। তখন থেকেই তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেন ভেষজ গাছপালা থেকে প্রাপ্ত ঔষধি গুণ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণায়। বাংলার পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা উদ্ভিদের রাসায়নিক শক্তি পরীক্ষার মাধ্যমে চেষ্টা করতে থাকেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন দ্বারপ্রান্ত খুলে দেওয়ার। ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি গবেষণা শুরু করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু একেবারেই সহজ ছিল না সেই কাজটা। স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক দেশের পালাবদলের কালে যথেষ্ট অর্থসাহায্য ছিল না রাষ্ট্রের তরফ থেকে। অভাব রয়েছে আদর্শ পরিকাঠামোর। তাছাড়া নারী বিজ্ঞানী হিসেবে গবেষণা করার ক্ষেত্রে পথটা একেবারেই সহজ ছিল না। সেই সময়ে মাত্র তিনশো টাকা অনুদান দেওয়া হত গবেষণার জন্য। কিন্তু তাই দিয়েও লড়াই চালিয়ে গেলেন অসীমা।

১৯৪৫ সালে তাঁর বিয়ে হয় আরেক বিখ্যাত রসায়নবিদ বরদানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি তখন ছিলেন শিবপুর বি ই কলেজের অধ্যাপক। কিছুদিনের মধ্যে অসীমার কাজের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে বিদেশেও। ডাক আসে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আমেরিকার উইস্কনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি সাহচর্য লাভ করেন নোবেলজয়ী রসায়নবিদ লিনাস পলিং-এর। আবার সুইজারল্যান্ডের জুরিখে থাকাকালীন একসঙ্গে কাজ করেন বিজ্ঞানী পল কারেরের সঙ্গে। চাইলে অনায়াসে শিক্ষকতা করতে পারতেন বিদেশের মাটিতে। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন, দেশের মানুষকে যদি স্বল্পমূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়, তাহলে বেছে নিতে ভেষজ পদ্ধতিকেই। 

আরও পড়ুন
অবহেলায় কৃষি বিজ্ঞানী বশী সেনের বসতবাড়ি, ছিল বহু ইতিহাসের সাক্ষী

এ বিষয়ে সাক্ষ্যবহন করে তাঁর পরিমার্জনা ও সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ভারতীয় বনৌষধি’ গ্রন্থটি। কিংবা ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’-র সম্পাদনার কাজেও তিনি পরিচয় করেছেন পাণ্ডিত্যের। তাঁর লেখা চারশোরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে দেশ-বিদেশের বিজ্ঞান জার্নালে। ১৯৫৪ সালে রাজাবাজারের বিজ্ঞান কলেজের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক রূপে যোগদান করেন। ১৯৫১ সালে লাভ করেন ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘শান্তিস্বরূপ ভাটনগর’ পুরস্কার। ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত অলংকৃত করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যশালী ‘খয়রা অধ্যাপক’-এর পদ। ১৯৭৫ সালে প্রথম মহিলা হিসেবে সভাপতির দায়িত্বপালন করেছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের। বিজ্ঞানে সার্বিক অবদানের জন্য পদ্মভূষণ সম্মানও অর্জন করেন তিনি।

আরও পড়ুন
ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাসের বিচিত্র গল্প শুনিয়েছেন বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ

তবে অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের সর্বাধিক কৃতিত্ব মৃগী ও ম্যালেরিয়া রোগের ওষুধ আবিষ্কারের গবেষণায়। তাঁর ‘আয়ুষ-৬৪’ ম্যালেরিয়ার আর ‘আয়ুষ-৫৬’ মৃগীরোগের ওষুধ হিসেবে প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। দুটি ক্ষেত্রেই তিনি ব্যবহার করেছিলেন শুষনি, চিরতা, ছাতিমের মতো ভেষজ উদ্ভিদ। ভিনকা অ্যালকালয়েডের মাধ্যমে ক্যানসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ দিশা দেখায় তাঁর গবেষণা। দীর্ঘ জীবনে বহুভাবে সমৃদ্ধ করেছেন দেশের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির ঐতিহ্যকে। শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি নিযুক্ত থেকেছেন জনসেবার কাজেও। ২০০৬ সালের ২২ নভেম্বর প্রয়াণ ঘটে অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের। কিন্তু তাঁর পথ ধরেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আগমন ঘটেছে বহু নারীর। শারীরিক অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেলেও, ইতিহাসের অন্তরালে আজও অনুঘটকের মতো কাজ করে চলে অসীমা ও তাঁর গবেষণা।  

Powered by Froala Editor