‘পঢ়ে ফারসি বেচে তেল, দেখো ইয়ে কুদরত কা খেল’—যার অর্থ, ভাগ্যের দুর্বিপাকে ফারসি পড়েও কিনা তেল বেচতে হচ্ছে। উনিশ শতকের কথা। সরকারি ক্ষেত্রে ফারসি ভাষার প্রয়োগ তখন অস্তমিত। নতুন শাসক ইংরেজ, তার ভাষাতেই চলবে রাজকার্য। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। একের পর এক তৈরি হচ্ছে ইংরেজি স্কুল। অতএব, ইংরেজি ভাষা না শিখলে চাকরি হবে না, ব্যবসা চলবে না। আইন-আদালতের ভাষা বদলে গেছে ইংরেজিতে। সাধারণ বাঙালিরও ইংরেজি ভাষার ‘হাতেখড়ি’ দরকার। কিন্তু শেখাবে কে? তার উপযুক্ত বই কোথায়? এগিয়ে এলেন প্যারীচরণ সরকার (Peary Charan Sarkar)। ১৮৫০ সালে প্রকাশিত হল তাঁর ‘ফার্স্ট বুক অফ রিডিং ফর নেটিভ চিলড্রেন’। বাঙালির ইংরেজি শিক্ষার জগতে শুরু হল নতুন এক অধ্যায়। শুধু বাঙালিই বা বলি কেন? এই বইটি-সহ আরও কয়েকটি ইংরেজি শেখার গ্রন্থ অনুবাদ করা হয়েছিল ভারতের আরো বহু ভাষায়।
ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এখন তো প্রায় দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে পড়ে। মুখে যাই বলা হোক না কেন, ইংরেজি বর্তমানে সামাজিক প্রতিষ্ঠার পরিচয়। অথচ, পথপ্রদর্শকের নাম জন্মের দুশো বছর পরেও আলোচনার কেন্দ্র হয়ে ওঠে না। ১৮২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় প্যারীচরণ সরকারের জন্ম। তাঁদের বংশের আদি পদবি ছিল দাস, নবাবের থেকে পেয়েছিলেন ‘সরকার’ উপাধি। পিতা ভৈরবচন্দ্র সরকার ব্যবসায় প্রচুর অর্থ রোজগার করলেও, অকালে মৃত্যু ঘটে তাঁর। ফলে দারিদ্র্য পিছু ছাড়েনি একেবারেই। ডেভিড হেয়ারের স্কুলে পড়াশোনা শেষ করার পর ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। ১৮৪৩ সালে বড়দা পার্বতীচরণের মৃত্যুর পর শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে চাকরির নেন হুগলির একটি স্কুলে। কয়েক বছর পর বারসাতের একটি স্কুলে যুক্ত হন প্রধান শিক্ষক রূপে।
প্রকৃত অর্থে, এখান থেকেই যাত্রা শুরু প্যারীচরণের। তাঁর অভিভাবকত্বে ছড়িয়ে পড়ে স্কুলের খ্যাতি। এই স্কুলে থাকাকালীনই লেখেন ইংরেজি শিক্ষার উপযোগী বই ‘ফার্স্ট বুক অফ রিডিং ফর নেটিভ চিলড্রেন’। এরপর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে ‘সেকেন্ড’, ‘থার্ড’, ‘ফোর্থ’, ‘ফিফথ’, ‘সিক্সথ’ পর্যন্ত। বারাসাতে বন্ধু কালীকৃষ্ণ মিত্র ও নবীনকৃষ্ণ মিত্রের সঙ্গে ১৮৪৭ সালে তৈরি করেন বাংলার প্রথম মেয়েদের স্কুল। যার নাম ‘বারাসাত কালীকৃষ্ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’। পরে কলকাতায় চোরবাগানের নিজের বাড়িতেও গড়ে তুলেছিলেন ‘চোরবাগান বালিকা বিদ্যালয়’। ১৮৫৪-তে বদলি হয়ে আসেন ‘হেয়ার স্কুল’-এ। ১৮৬৭-তে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত হন প্রেসিডেন্সির কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বাঙালি অধ্যাপক রূপে।
তবে শুধু শিক্ষকতা বা শিক্ষাবিস্তারের কাজেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। উনিশ শতকের বাংলায় যে বিরাট সামাজিক পালাবদলের আয়োজন চলছিল, তার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন সময়ে। স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের কাজে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহকর্মী। বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বহুবিবাহ বন্ধেও দু’জনে কাজ করেছেন একসঙ্গে। ১৮৬৩-তে গড়ে তোলেন ‘বঙ্গীয় সুরাপান নিবারণী সভা’। বাংলা ও ওড়িশায় দুর্ভিক্ষার সময়ে তাঁর ‘চোরবাগান অন্নসত্র’-এ প্রত্যেকদিন পাত পড়ত প্রায় ন’শো লোকের। কলকাতায় তখন দূর-দূরান্ত থেকে পড়তে আসত ছাত্ররা। এত বড়ো শহরে তাদের কোনো অভিভাবক নেই, মাথার উপর ছাদ নেই। রয়েছে অন্যান্য নৈতিক বিপদের সমস্যাও। মাসিক চল্লিশ টাকায় ৪৫ জন ছাত্রের উপযোগী একটি বাড়ি ভাড়া নেন তিনি। সরকার থেকে বিন্দুমাত্র সাহায্য না এলেও, প্যারীচরণ থামেননি। সম্পূর্ণ নিজের অর্থ ব্যয় করে গড়ে তুললেন ‘ইডেন হিন্দু হোস্টেল’। নিযুক্ত করলেন একজন অবৈতনিক চিকিৎসক ও তত্ত্বাবধায়ক। পরে অবশ্য ইংরেজ সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় নিশ্চিন্ত হন প্যারীচরণ।
আরও পড়ুন
প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও বাঙালির তৈরি প্রথম থিয়েটারের গল্প
এমনিতে মিতভাষী হলেও ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলে ছিলেন অত্যন্ত প্রাণখোলা। যাঁদের মধ্যে নাম করতে হয় কালীকৃষ্ণ মিত্র, প্রসন্নকুমার গুপ্ত এবং অবশ্যই বিদ্যাসাগরের। দুজনের বন্ধুত্বের কাহিনিও ছিল বেশ প্রচলিত। বিদ্যাসাগর প্রয়োজন পড়লে নির্দ্বিধায় হাত পাততেন তাঁর কাছে। একদিন হঠাৎ বিদ্যাসাগর এসে উপস্থিত তাঁর বাড়িতে। অবিলম্বে তিন হাজার টাকা চাই, অত্যন্ত দরকার। ঘটনা হচ্ছে, একটা লোকের চাকরির জন্য বিদ্যাসাগর দাঁড়িয়েছিলেন জামিন হয়ে, শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তি পালিয়েছে তিন হাজার টাকা নিয়ে। এখন ওই টাকা দিতে হবে তাঁকেই। এদিকে প্যারীচরণের তহবিলে তখন পড়ে আছে মাত্র দু’হাজার টাকা। মায়ের থেকে আরো এক হাজার টাকা নিয়ে এসে সে যাত্রা বিদ্যাসাগরের মুখরক্ষা করলেন। সে তো হল, কিন্তু হিসেবের খাতায় কী লেখা হবে? প্যারীচরণ জানালেন, এটাকে তাঁর নামে ‘বাজেখাতার খরচ’-এ লিখে রাখতে। এরকমই ছিল দু’জনের বন্ধুত্ব। অবশ্য বিদ্যাসাগরও কারোর অর্থ ঋণ বাকি রাখতেন না। ফলে এই নিয়ে যে দুজনের মধ্যে একপ্রস্থ বন্ধুসুলভ তর্ক-বিতর্ক হয়নি, তা কে বলতে পারে?
আরও পড়ুন
ফটোগ্রাফির আদিযুগ ও বাঙালি মহিলা ফটোগ্রাফারের কাহিনি
১৮৭৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন তিনি। তার কয়েকবছর পরে ১৮৮০ সালে প্রকাশিত হয় দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ নামের একটি নকশা জাতীয় গ্রন্থ। সার দেশ ঘুরে স্বর্গের দেবতারা এসেছেন কলকাতায়। বহু দ্রষ্টব্য স্থান দেখলেন, জানলেন বহু মানুষ সম্পর্কে। শেষে ব্রহ্মা বরুণদেবকে বললেন, “আমাকে প্যারীচরণ সরকারের জীবনচরিত বল?” বর্ণিত হল তাঁর মাহাত্ম্যের কাহিনি। প্যারীচরণের বই যে বাঙালির ইংরেজি শিক্ষার প্রথম সোপান, সেকথাও উল্লেখ করলেন বরুণদেব। কাল্পনিক, তবু দেবতাদেরও জানার প্রয়োজন ছিল প্যারীচরণের জীবনবৃত্তান্ত। আর এত বছর পরে ইংরেজি শিক্ষায় ‘মানুষ’ হয়েও বাঙালি কি যোগ্যসম্মান দিতে পেরেছে তার শিক্ষককে?
ঋণস্বীকার :
প্যারীচরণ সরকার (জীবনবৃত্ত), শ্রীনবকৃষ্ণ ঘোষ
প্যারীচরণ সরকার—এক বিস্মৃতপ্রায় মনীষী, মণিমেখলা মাইতি, সিলি পয়েন্ট
রবীন্দ্রনাথও তাঁর বই পড়েছেন, পবিত্র সরকার, সংবাদ প্রতিদিন
Powered by Froala Editor