মুখে মুখে করে দিতে পারতেন গণিতের জটিল হিসেবনিকেশ। সংখ্যারা যেন তাঁর অধীনস্থ প্রজা। কিন্তু কেই-বা মাথা ঘামায় এক ক্রীতদাসের প্রতিভা নিয়ে? আমেরিকার ভার্জিনিয়া অঞ্চলে সারাদিন কাটত মালকিনের ক্ষেতে চাষবাস করে। আর সুযোগ পেলে অঙ্কের জাদুতে একাই মজে থাকতেন কৃষ্ণাঙ্গ থমাস ফুলার (Thomas Fuller)। কখনও গুনতেন গরুর লেজ, কখনও বা ফসলের বীজ। যদিও প্রথমে আর পাঁচজন আফ্রিকান ক্রীতদাসের সঙ্গে তাঁর কোনো পার্থক্য দেখেনি আঠারো শতকের শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা। জীবনের বহু বসন্ত পার করে অবশেষে মিলল সর্বস্তরের পরিচিতি। ‘অশিক্ষিত’ আফ্রিকাবাসীর ক্ষমতায় হতভম্ব হয়ে গেলেন সভ্য প্রভুরা। তাঁর নতুন নামকরণ হল ‘ভার্জিনিয়া ক্যালকুলেটার’ (Virginia Calculator)।
আসল নাম অবশ্য থমাস ফুলার। ১৭১০ সালে পশ্চিম আফ্রিকার কোনো এক অখ্যাত অঞ্চলে জন্ম। আজকের দিনের হিসেবে লাইবেরিয়া ও বেনিনের মাঝামাঝি স্থানে। ইউরোপীয় ও আমেরিকানদের কাছে অবশ্য একসময়ে ‘স্লেভ কোস্ট’-এর থেকে বেশি কিছু ছিল না এই অঞ্চলগুলি। ফলে ব্যতিক্রমী কিছু ঘটেনি কৃষ্ণাঙ্গ থমাস ফুলারের জীবনেও। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ক্রীতদাস হয়ে যেতে হল আমেরিকা। পড়ে রইল দেশ, পরিবার-পরিজন। এটাই তো তখন নিয়তি ছিল অধিকাংশ আফ্রিকাবাসীর। উত্তর ভার্জিনিয়ার এলিজাবেথ কক্সের খামারে ঠাঁই মিলল ফুলারের। ঘটনাচক্রে তাঁর মালকিনও ছিলেন ‘অশিক্ষিত’। ফলে ২৩২ একর জমির পুরো হিসেব রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর কাঁধে। কিন্তু, ব্যাস ওইটুকুই। রোদে-বৃষ্টিতে মাঠের চাষের কাজের বেশি ‘যোগ্যতা’ অর্জন করতে পারেননি কখনই।
অথচ, সংখ্যা দেখলেই যেন ভিতরে খেলে যায় একটা শিহরন। নিজের মনেই সমাধান করতে থাকেন অদ্ভুত সব অঙ্ক। কিছু না পেলে গরুর লেজ তো রইলই। দুটি বস্তুর মধ্যে দূরত্ব কিংবা জ্যোর্তিবিদ্যা সংক্রান্ত গণনাও নাকি তিনি জানতেন। স্বাভাবিকভাবেই আশেপাশের খামার মালিকদের নজর পড়ল তাঁর উপর। কক্স পরিবারের কাছে আসতে থাকে ফুলারকে কেনার লোভনীয় প্রস্তাব। প্রতিবারই নাকচ করে দেন তাঁরা। ফুলার চলে গেলে এত বড়ো জমি-জায়গার হিসেব রাখার ক্রীতদাস মিলবে কোথায়? অবশেষে ১৭৮০ সালে পেনসিলভিনিয়ার এক ব্যবসায়ী ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মী আসেন ভার্জিনিয়ার খামারবাড়িতে। ফুলারকে নিয়ে শুনেছেন বেশ কিছু গল্প, নিজেদের চোখে পরীক্ষা না করে দেখলে কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না। ফুলার তখন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ। কালো মুখে ধূসর চুল-দাড়িতে জানান দিচ্ছে বয়স। একসময়ের শক্তিশালী মাংসপেশী নুইয়ে পড়লেও, অব্যাহতি মেলেনি কাজ থেকে। তবে চোখের তারা আর মস্তিষ্ক আজও সজাগ। মরচে ধরেনি অঙ্কের প্রতিভাতেও। শোনা যায়, আগন্তুকরা কয়েকটি কঠিন প্রশ্ন করেছিলেন তাঁকে। যার মধ্যে দুটি বহুচর্চিত। এক, দেড় বছরে কত সেকেন্ড থাকে? দুই, একজন মানুষ যদি ৭০ বছর, ১৭ দিন, ১২ ঘণ্টা বাঁচে, তাহলে সেকেন্ডের হিসেবে তাঁর আয়ু কত? ঠিক দু মিনিটের মাথায় দুটি প্রশ্নেরই উত্তর দেন ফুলার। সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি জানান এক ব্যক্তি, প্রথম প্রশ্নের উত্তর এত বেশি হতে পারে না। মৃদু হেসে শুধু ১৭৮০ সাল যে ‘লিপ ইয়ার’, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন ফুলার।
এই আগন্তুকরা ছিলেন পেনসিলভ্যানিয়ার দাসপ্রথাবিরোধী সংগঠনের সদস্য। তাঁদের মাধ্যমে খবর পৌঁছোয় বেঞ্জামিন রাশের (Benjamin Rush) কাছে। যিনি দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সেই সময়ের সবচেয়ে বড়ো প্রতিবাদী মুখ। ফুলারকে তিনি নিয়ে আসেন জনসমক্ষে। কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসরাও যে প্রতিভার জোরে আমেরিকানদের উর্ধ্বে উঠতে পারে, তারাও যে ‘মানুষ’-এর মতো সম্মানের অধিকারী, তা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। রাশের আন্দোলন পরবর্তীতে সাফল্যের মুখ দেখলেও, ফুলারের গল্প এগোয়নি বেশি দূর। ততদিনে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, বিজ্ঞানমহলে নাম হয়েছে ‘ভার্জিনিয়া ক্যালকুলেটার’ বলে। অনেকে অবশ্য সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তাতে চিরাচরিত বর্ণবিদ্বেষের প্রভাবও একেবারে অস্বীকার করা যাবে না। অবশেষে ১৭৯০ সালে কক্স ফার্মেই মারা যান তিনি।
আরও পড়ুন
কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের আস্ত ব্যাটেলিয়ান, ‘লড়েছিল’ বিশ্বযুদ্ধের ময়দানেও
কিন্তু কীভাবে অঙ্ক শিখলেন ফুলার? মাতৃভূমিতে তো পড়াশোনার সুযোগ ছিল না, বাকি জীবনটাও কেটেছে মাঠেঘাটেই। কারোর থেকে নয়, জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। গরুর লেজ বা ফসলের বীজেই হয়েছিল হাতেখড়ি। আরেকটি মতে, তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন ‘বাসারি’ সম্প্রদায়ের, যাদের খ্যাতি রয়েছে হিসাবশাস্ত্রে। তাতেও দাস থাকতে হয়েছে আজীবন। কয়েকটি মুদ্রার বিনিময়ে বেচে দেওয়া হয়েছিল যাকে, তাঁর চোখে খেলা করত বিপুল অর্থের হিসেব। ‘মানুষ’-এর সম্মান যিনি দীর্ঘদিন পাননি, শেষ শ্রদ্ধায় বোস্টনের ‘কলম্বিয়ান জেনারেল’ পত্রিকা তাঁকে সম্বোধন করে ‘নিউটনের বিজ্ঞান-সম্পর্কিত ভাই’ বলে। বহু কৃষ্ণাঙ্গকে প্রেরণা জুগিয়েছে তাঁর জীবন, ‘শিক্ষা’র সংজ্ঞা বদলেছে তাঁর হাতে। মোট কথা, ফুলার ছিলেন ‘স্বশিক্ষিত’। আর এ তো সবাই জানে “স্বশিক্ষিত মাত্রেই সুশিক্ষিত।”
আরও পড়ুন
২৫০ বছর আগে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের জন্য কলম ধরেছিলেন এই ক্রীতদাস-কবি
Powered by Froala Editor