অন্ধত্ব ছিল বাল্যসঙ্গী, মানসচক্ষেই সঙ্গীতের মায়াজাল বুনতেন কৃষ্ণচন্দ্র দে

ছেলেটির নেশা ছিল ঘুড়ি ওড়ানো। দুপুর রোদে গনগনে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতেন দিনের পর দিন। একদিন আচমকাই লাল হয়ে গেল দু’চোখ। সঙ্গে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। তড়িঘড়ি ছোটা হল মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু সমাধান মিলল না। দীর্ঘ চিকিৎসার পরেও একদিন সকালে উঠে অন্ধকার ছাড়া কিছুই রইল না চোখে। মাত্র বারো বছর বয়স তখন তাঁর। অপূর্ব সুন্দর চেহারা, তেমনই সুন্দর কণ্ঠস্বর। বাড়িতে হোক বা রাস্তাঘাটে, কাউকে গান গাইতে শুনলেই অনায়াসে তুলে নিতে পারতেন সেই গান। অন্ধ হয়ে যাওয়ায় শেষ হয়ে গেল পড়াশোনার পালা। এভাবেই কি কাটবে সারাটা জীবন? শেষে ঠাকুমার আদেশে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল সেই সময়ের বিখ্যাত গায়ক শশীভূষণ দে-র কাছে। তাঁর কাছেই শুরু হল কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সঙ্গীতচর্চার প্রথম অধ্যায়।

১৮৯৩ সালে জন্ম। সেদিন ছিল জন্মাষ্টমী। জন্মতিথি অনুসারেই নাম রাখা হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্র। মাত্র দেড় বছর বয়সে পিতৃবিয়োগের শোক সামলে নতুন জীবন শুরু করার মুখেই নেমে আসে অন্ধকার। কিন্তু দৃষ্টিহীনতা তাঁর কণ্ঠের লাবণ্যকে হারিয়ে দিতে পারেনি। বরং খুলে গেছিল অন্তর্দৃষ্টি। জগৎ আর জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন চোখের আলোর বাইরে। পরবর্তীতে যতবার মুম্বই যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে, ততবার চলে যেতেন সমুদ্রের পারে। অন্তহীন জলরাশির গর্জনের লয়ের সঙ্গে বদলে যেত তাঁর অভিব্যক্তি। কানের ভিতর দিয়ে মরমে অনুভব করতেন প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য। সেবার ভাতুষ্পুত্র মান্না দে তাঁর সঙ্গী। হঠাৎই শুনতে পেলেন প্রিয় ‘বাবুকাকা’ ধরেছেন নিজেরই গাওয়া এক পুরনো গান, ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সঙ্গীত ভেসে আসে’। কেমন সমুদ্র দেখলেন তিনি? উত্তর করলেন, “আমি তো তোমাদের মতো করে দেখতে পাই না, কিন্তু আমি যেমনটা দেখেছি, তোমরা বোধহয় তেমন করে দেখতে পাওনি।”

অথচ, এই মানুষটাকেই সঙ্গীত জীবনের শুরুতে শুনতে হয়েছে কত কটু কথা। শশীভূষণ দে-র কাছে গান শেখার পরই ডাক আসে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ থেকে। আঠারো বছর বয়সে গাওয়া প্রথম গান ‘ওমা দীন-তারিণী তারা’ স্থান করে নেয় বাঙালির অন্তরমহলে। শেখার পালা কিন্তু তখনও শেষ হয়নি। পরবর্তীতে তালিম নিয়েছেন সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেরামতুল্লা খান, বদল খান প্রমুখের কাছে। শাস্ত্রীয়সঙ্গীত, টপ্পা, খেয়াল, কীর্তন সর্বত্র অবাধ যাতায়াত তাঁর। অথচ তারপরেও শুনতে হয়েছে ‘কেষ্টবাবু’ হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের কিছুই জানেন না। ধ্রুপদ, ধামারে গান তিনি গাইতে পারবেন না। জেদের বশেই চার বছর ধরে ধ্রুপদ শেখেন ওস্তাদ দবির খানের কাছে। 

আজীবন নিজেকে সঙ্গীতের ছাত্র হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। অথচ থিয়েটারে বা সিনেমায় তাঁর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। ১৯২৪ সালে শিশিরকুমার ভাদুড়ির ‘সীতা’ নাটকের প্রযোজনা বদলে দেয় বাংলা মঞ্চের গতিপথ। সেই নাটকে সঙ্গীত পরিচালনা ও বৈতালিকের চরিত্রে দুটি গান গাওয়ার অনুরোধ আসে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে। গান দুটি ছিল ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রুবাদল ঝরে’ ও ‘জয় সীতাপতি সুন্দরতনু প্রজারঞ্জনকারী’। তখনও থিয়েটারে যন্ত্রব্যবস্থা তত উন্নত হয়নি। খালি গলার গানই পৌঁছে দিতে হবে কয়েকশো মানুষের কাছে। প্রথম গানটি যখন তিনি গাইলেন, তখন স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো প্রেক্ষাগৃহ। শুধু শোনা যাচ্ছে তাঁর বেদনার্তি গলার আর্তি। ‘কোথায় আলো? কোথায় আলো?, আকাশ ধরা কালোয় কালো?’ এ কি সীতাহীন রামচন্দ্রের কথা? আসলে তো কোথাও কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনের গল্প ধরা রইল এই গানে। তাঁর কণ্ঠ থামলে দর্শকমহল থেকে উঠতে লাগল ‘এনকোর’ ধ্বনি। অর্থাৎ আবার গাওয়া হোক এই গান। সে রাত্রে তিনবার এই গান গাইতে হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্রকে। একই ঘটনা ঘটেছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে ভিখারির ভূমিকায় ‘ঐ মহাসিন্ধুর ওপার হতে’ গানটি গাওয়ার সময়।

আরও পড়ুন
মাধব আর আনোয়ার ছিল প্রথম ‘গুরু’, গানের সুরে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান শচীন কর্তা

অসংখ্য নাটকে গান করেছেন তিনি। ‘চণ্ডীদাস’, ‘দেবদাস’, ‘গৃহদাহ’, ‘বিদ্যাপতি’-র মতো ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা ও নেপথ্য কণ্ঠদানের কৃতিত্ব তাঁর। ১৯৩৯ সালে সুরারোপ করেন হিন্দি ছবি ‘তমন্না’-তে। রঙমহল থিয়েটারে থাকাকালীন গোপনে বিবাহ করেন তারকবালা বা ‘মিস লাইট’-কে। একটি পুত্রসন্তানও হয়। কিন্তু মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। জীবনে এরকম আঘাত বারবার সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। সেই পিতৃবিয়োগের সময় থেকেই। প্রতারিত হয়েছিলেন বলিউডের সঙ্গীতমহল থেকেও। এই বাংলাতেও কি সবক্ষেত্রে যোগ্য সম্মান পেয়েছিলেন তিনি? অন্ধত্বের জন্য অনেকেই আড়ালে তাঁকে ডাকত ‘কানা কেষ্টো’ বলে। কিন্তু বাকি ঝড়-ঝাপটার মতোই এই অপবাদও তিনি চিরাচরিত হাসিমুখে সামলাতেন। বলতেন, “আমি কানাই বটে, তবে শুধু আমি একাই নয়। উপরে যে ব্যাটা বৈকুণ্ঠে বসে বসে মৌজ করছে, সেই কেষ্ট ব্যাটাও তো কানা।”

আরও পড়ুন
মান্না দে-র হাতে দায়িত্ব দিয়ে, মুম্বাই ছেড়ে কলকাতায় ফিরতে চেয়েছিলেন শচীন কর্তা!

শরীরে যে প্রতিবন্ধকতাই থাকে, হৃদয়ে তার আঁচ লাগতে দেননি। প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করার ক্ষমতা না থাকলেও নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের। সেই দেশাত্মবোধ থেকেই তিনি সুরারোপ করেন মোহিনী চৌধুরীর ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ গানটিতে। ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি লড়াইয়ের মৌন মলিন মুখে ভাষা জুগিয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্রের গান। ১৯৬২ সালে তাঁর প্রয়াণ ঘটলেও, বিজয়লক্ষ্মীর দেওয়া রক্তকমল গাঁথা মালা তাঁর বুকে আজও বিরাজমান।

ঋণস্বীকার : 

ওস্তাদ কাহিনী, অজিতকৃষ্ণ বসু
সুরের আকাশে কৃষ্ণচন্দ্র, মান্না দে
অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই তিনি সুরসাধনা, বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ মে, ২০১৯

Powered by Froala Editor