১৯৪২ সাল। কিছুদিন আগেই দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁ গ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছেন তৃপ্তি ভাদুড়ী। ম্যাট্রিকুলেশনের দরজা পার না করলেও নাটকে অভিনয় করা নিয়ে প্রবল আগ্রহ তাঁর। আশুতোষ কলেজে পড়ার সময় গার্লস স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভ্য হয়ে একাধিক নাটকে যুক্ত থাকার সুযোগও হয়েছে। কলকাতায় বড়োমামা সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারেরও প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল স্বভাবলাজুক মেয়েটির ভালোবাসার প্রতি। তখন অ্যাসোসিয়েশনের রিহার্সাল হত তাঁর দিদি শান্তিদেবী ও জামাইবাবু অরুণ মিত্রের সদানন্দ রোডের বাড়িতে। শিক্ষক হিসেবে আসতেন শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু ভট্টাচার্য প্রমুখ। কেউই তখন নিজস্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত নন ঠিকই, তবে ভবিষ্যতের আলোর নিশানা সুস্পষ্ট করে তুলছিল বাংলার সংস্কৃতিচেতনার নতুন পথ। তৃপ্তিও যুক্ত হয়ে পড়লেন তাঁদের সঙ্গে। কোনো এক অনুষ্ঠানে নামতে হল পুরুষের ভূমিকাতেও। অভিনয় চলাকালীন জোরে হাত নাড়তেই শার্টের হাতার ভিতর থেকে রিনিঝিনি করে বেজে উঠল একগোছা চুড়ি। অপ্রস্তুতের একশেষ! কোনোরকমে অভিনয় শেষ করে যেন ঠিক করলেন, আর কোনোদিন মঞ্চে না উঠতে পারলেই বাঁচেন।
ঠিক তার পরের বছরেই তাঁকে দেখা যাবে ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের ‘আগুন’ নাটকে। নাটককার ও পরিচালক বিজন ভট্টাচার্য। ততদিনে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছেন এ.আর.পি-র কাজে। সময়টাও ভারতের পক্ষে অনুকূল নয়। একদিকে স্বাধীনতা আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অন্যদিকে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’-এ ছারখার হয়ে যাচ্ছে গোটা বাংলা। পড়াশোনা বন্ধ রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের লড়াইয়ে। গ্রাম ফেলে চলে আসা সহায় সম্বলহীন কৃষকদের জন্য জীবন উৎসর্গ তাঁর। আসলে কোথাও যেন একটা অস্পষ্ট মিল ছিল নিজের জীবনের সঙ্গেও। পিতা আশুতোষ ভাদুড়ি যখন যক্ষারোগগ্রস্ত, পরিবাবের মুখে খাবার জোটে না, সেই অনিশ্চিত দিনগুলিতেই এক কিশোরী বালিকা চলে এসেছিলেন কলকাতার অচেনা পরিবেশে। চুপ করে সম্পূর্ণ করতেন নিজের কাজটুকু। এতটাই নীরব হয়ে থাকতেন, যাতে সত্যেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল ‘মেয়েটি কি বোবা নাকি?’ এই আশঙ্কা আর নিরাপত্তাহীনতা যেন আজীবন সঙ্গী থেকেছে তাঁর, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে অনেকে সিদ্ধান্তে।
১৯৪৪ সালে অভিনীত হল গণনাট্য সংঘ প্রযোজিত বিজন ভট্টাচার্যের নাটক ‘নবান্ন’। যুগ্ম পরিচালক বিজন ভট্টাচার্য ও শম্ভু মিত্র। বাংলা থিয়েটারের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এই নাটকে বিনোদিনীর চরিত্রে অভিনয় করেন তৃপ্তি ভাদুড়ী। আমিনপুর গ্রাম থেকে খাদ্যের সন্ধানে কলকাতায় আসা এক পরিবারের সরল বালিকা বধূ সে। সন্তানসম মাখনকে কেড়ে নিয়েছে দুর্ভিক্ষ, নিজে ভুল পথে চলেছে জনৈকের ‘টাউট’-এর পাল্লায় পড়ে। এসব কি নিছকই অভিনয়? না, বরং জীবন থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে খুঁজে পেয়েছিলেন অভিনয়ের প্রতিটি দৃষ্টিকোণ। মন্বন্তরের কলকাতার ‘ফ্যান দাও’ ধ্বনি ক্রমাগত বেজে চলত নাটকের মঞ্চে। প্রতিটি অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের দরজার সামনে, বলা ভালো নর্দমার সামনে হাড় জিরজিরে মানুষের ভিড়। নর্দমা থেকে বেরিয়ে আসা উচ্ছিষ্ট ফ্যানের জন্য অশক্ত শরীরে নিজেদের মধ্যে লেগে যেত মারামারি। একদিন উপরের ঘরের জানলা থেকে প্রত্যক্ষ করলেন সেরকমই এক ঘটনা।
এক শীর্ণ, কঙ্কাল হয়ে যাওয়া মা কেড়ে খেল এক হাঁড়ি ফ্যান। ছোটো অভুক্ত সন্তানরা তার কাছে আসতেই প্রবলভাবে তাড়িয়ে দিল তাদের। খাওয়া যখন প্রায় শেষের পথে, তখন শুরু হল কান্না। কেন খেয়ে ফেলল? কেন রাখল না সন্তানদের জন্য? এই আফসোসটা বেজেছিল তৃপ্তি ভাদুড়ীর মধ্যেও। ওই মরা মাছের মতো চোখগুলো দেখে ক্ষুধাতৃষ্ণ হারিয়ে গেছিল শরীর থেকে। চাপা পড়ে থাকত ভাত, খেতে পারতেন না। এ.আর.পি-র কাজের সূত্রে এদের সঙ্গেই তো সংসার ছিল তাঁর। একবার খাবার দেওয়া হয়েছে দুর্ভিক্ষগ্রস্ত মানুষদের। একটি মেয়ের লোলুপ চোখে যেন আর তর সইছে না অপেক্ষার। কিন্তু খাবার পৌঁছোনোর আগেই ঢলে পড়ে মেয়েটি। কোনোরকমে মাটি কামড়ে এগিয়ে যেতে চায় খাবারের দিকে। তৃপ্তি কোলে তুলেন তাঁকে। কপাল থেকে মুছে গেছে আবছা সিঁদুর, ক্লান্ত হাতদুটি বাড়িয়ে রয়েছে খাবারের দিকে। ওই অবস্থাতেই মৃত্যু ঘটল তার, তৃপ্তি ভাদুড়ীর কোলে।
আরও পড়ুন
থিয়েটারের জন্য চড়া সুদে টাকা ধার, গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল ‘দেউলিয়া’ শিশির ভাদুড়িকে
সেদিন কাঁদতে পারেননি তিনি, কিন্তু পালটে গেছিল জীবনধারা। হয়তো কিছু করার নেই, সামর্থ্যই বা কতটুকু? তবু থিয়েটারকে সম্বল করে যে পথটুকু হাঁটা সম্ভব, সেই পথই বেছে নেন তিনি। থিয়েটারের মধ্যেই খুঁজে পান বাঁচার রসদ। গণনাট্যের উত্তাল দিনগুলি পার করে চলে আসেন ‘বহুরূপী’-তে। ১৯৪৫-এ শম্ভু মিত্রের সঙ্গে বিবাহসূত্রে হন তৃপ্তি মিত্র (Tripti Mitra)। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধায়’ উপন্যাসের এলা চরিত্র থেকে ‘রক্তকরবী’-র নন্দিনী হয়ে ‘পুতুল খেলা’-র বুলু—সর্বত্র সাক্ষ্য রেখেছেন অপরিসীম অভিনয় প্রতিভার। ‘বহুরূপী’ থেকে সরে এসে তৈরি করেন নিজস্ব ‘আরব্ধ নাট্যবিদ্যালয়’। আবার ‘অপরাজিতা’ নাটকে একা অভিনয় করেছিলেন আঠারোটি চরিত্রে।
আরও পড়ুন
প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও বাঙালির তৈরি প্রথম থিয়েটারের গল্প
আসলে তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে হয়তো বহুভাবে জড়িয়ে যায় শম্ভু মিত্রের নাম। সেই সংক্রান্ত নানা অযাচিত বিতর্কও সঙ্গী হয় আলোচনায়। কিন্তু ঠাকুরগাঁয়ের এক ছোটো বালিকার কলকাতা দেখার অভিজ্ঞতা যেভাবে তিলে তিলে তৈরি করে তৃপ্তি ভাদুড়ীকে, তার প্রসঙ্গ পড়ে থাকে কোনো ছাইচাপা আগুনের স্ফুলিঙ্গের মধ্যে।
Powered by Froala Editor