১৯৫৯ সাল। মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনীত হতে চলেছে উৎপল দত্তের রচনা ও পরিচালনায় ‘অঙ্গার’ নাটক। প্রযোজনা- এলটিজি, মঞ্চনির্মাণ- তাপস সেন এবং সঙ্গীত পরিচালক- পণ্ডিত রবিশঙ্কর। শেলডন কোলিয়ারির শ্রমিকদের জীবন ও সংগ্রামের ইতিবৃত্ত উঠে আসবে এ নাটকে। আসলে চিনাকুড়ি, বড়াধেমো, দামুরিয়া, কোলব্রুকের খনির একের পর এক দুর্ঘটনায় যারা সত্যিকারে দায়ী, উদঘাটন করা হবে সেই খনিমালিকদের কলঙ্কময় মুখোশ। শেষ দৃশ্যে কয়লাখনির ভিতরে ঢুকে পড়ে জল, বাঁচার অসহায় আর্তিতে চিৎকার করে ওঠে বন্দি শ্রমিকরা। কিন্তু জলের তোড়ে ভেসে যায় প্রাণের স্পন্দন। দর্শক বাকরুদ্ধ তাপস সেনের আলোকপরিকল্পনায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এটা মঞ্চ, বাস্তব নয়। তারপর ওঠে হাততালির ঝড়।
তিনশো রাত্রির উপর ‘হাউসফুল’ থাকে ‘অঙ্গার’। মঞ্চে উৎপল দত্ত, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভা সেন, নিমাই ঘোষের মতো বিরাট মাপের অভিনেতারা থাকতেও এই নাটকের জন্য বছরের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার। বাঙালি যাঁকে চেনে রবি ঘোষ (Rabi Ghosh) নামে। ছোটোখাটো পেটানো শরীর, অলৌকিক ‘টাইমিং’ আর চরিত্রের মনস্তত্ব সম্পূর্ণ রূপে আয়ত্ত করে শেষ মুহূর্তে তিনি চিৎকার করে উঠতেন, ‘এ আল্লা, দয়া নি করিবা আল্লারে’। তার আগেও একটা দীর্ঘ সংলাপ ছিল তাঁর চরিত্র সনাতনের কণ্ঠে। খনিতে তখন জলের স্রোত, অর্থাৎ আলোর খেলা। সংলাপ নয়, দর্শকের মন তখন পড়ে আছে সেই দিকে। কোথাও গিয়ে কি আঙ্গিকের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্বের ফলে নাটকের ক্ষতি হচ্ছে? যে শ্রমিকদের জন্য এত কিছু, তাঁদের মৃত্যুযন্ত্রণাই তো ভেসে গেল আলোর স্রোতে। একদিন বলেই বসলেন তাপস সেনকে, “দেখুন দাদা, টেকনিক্যাল কারবারের ওপরে হিউম্যান ভয়েস উইন করতে পারে না, সুতরাং আমি চেঁচাতে পারব না।” উৎপল দত্ত প্রতিবাদ করেননি তাঁর যুক্তিতে, তা বলে সেই দৃশ্য বাদও দেননি নাটক থেকে। বহু পরে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গে উৎপল দত্ত বলেছিলেন, “আমি, নিজে বিশেষ করে, আমার অঙ্গার নাটকটা পছন্দ করি না।”
রবি ঘোষের বাবা জিতেন্দ্রনাথ কিন্তু একেবারেই পছন্দ করতেন না ছেলের অভিনয় জগতে আসা। বরিশালের বাঙাল তাঁরা। দুজনেরই প্রচণ্ড জেদ। চাপা মান-অভিমানের পালা চলতে লাগল দিনের পর দিন। মাসে বড়োজোর একটা কথা বলতেন একে অপরের সঙ্গে। এর আগে ‘সাংবাদিক’, ‘ছায়ানট’-এ অভিনয় করলেও জিতেন্দ্রনাথ মাথা ঘামাতেন না ছেলের অভিনয় সম্পর্কে। বলতেন, “ও আবার কী অভিনয় করবে, ওই তো চাকরবাকরের মতো চেহারা। আমি দ্যাখসি দুগ্গা বাঁড়ুজ্যেকে।” কিন্তু কিছুটা পরিবর্তন আসে পরের দিকে। যার মূল কারিগর ছিলেন তাঁর ‘বস’ জাস্টিস এস এন গুহরায়। লিটল থিয়েটার গ্রুপের নাটক দেখে রবি ঘোষের অভিনয় প্রতিভা সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন জিতেন্দ্রনাথকে। তারপর দুয়েকটা শো দেখেন তিনি। বিশ্বাস করেন যে, ছেলে ‘ট্যালেন্টেড’। যখন ‘অঙ্গার’-এর ঘোষণা হল, তখন তো একেবারে ১৫টা টিকিট কেটে নিলেন। একা নয়, সব বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে দেখবেন সন্তানের অভিনয়।
এত সুখ বোধহয় লেখা ছিল না রবি ঘোষের জীবনে। ‘অঙ্গার’ অভিনয়ের সাত দিন আগে মারা গেলেন জিতেন্দ্রনাথ। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। একদিকে পিতার পারলৌকিক কাজ, অন্যদিকে থিয়েটারের ডাক। কিন্তু ‘শো মাস্ট গো অন’। কাছা গলায় দিয়ে অভিনয় করলেন প্রথম রজনীতে। যে নাটকের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেলেন, সেই অভিনয় দেখা হল না গর্বিত পিতার। আর ঠিক একশো দিনের মাথায় চলে গেলেন বড়ো জামাইবাবু। দুটো পরিবারের দায়িত্ব তাঁর উপরে। এলটিজি ছাড়লেন, কিছুটা আদর্শগত কারণ, বাকিটা পারিবারিক দায়িত্বের জন্য। সিনেমায়, পেশাদার থিয়েটারে অভিনয় করে চলল গ্রাসাচ্ছেদনের ব্যবস্থা। বছর কয়েক পরে বিবাহ করেন অনুভা গুপ্তকে। সে বিয়েও টিকল না বেশিদিন। ফাঁকি দিয়ে জীবনের অপর প্রান্তে চলে গেলেন অনুভা। কিন্তু ওই যে ‘শো মাস্ট গো অন’। জীবন বয়ে চলে নিজের ছন্দে। তিনি ‘কমেডিয়ান’, লোক হাসানো তাঁর কাজ। এটাই তো জানে সবাই। ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনার কি কোনো ভূমিকা আছে রুপোলি পর্দায়? সব তো আসলে সত্যি হলেও গল্প। কেউ আসে না, কারোর ফিরে আসার দরকার পড়ে না। শুধু ‘অঙ্গার’-এর শেষ দৃশ্যে অতলে তলিয়ে যাওয়ার আগে কি একবার ভেজা চোখ তাকিয়ে দেখেনি একটা ফাঁকা আসনের দিকে?
আরও পড়ুন
গান গাইতে হবে পরবর্তী সিনেমায়, সুমিত্রার কাছে অনুরোধ উত্তমকুমারের
ঋণস্বীকার : আপন মনে, রবি ঘোষ
আরও পড়ুন
'উম্মা'র বদলে 'উমা', বাঘের গর্জনে বেকায়দায় রবি ঘোষ
Powered by Froala Editor