‘অন্ত্রপ্রনর’ শব্দটি বর্তমানে বহুল প্রচারিত। সীমিত পুঁজি ও আর্থিক ক্ষতি সত্ত্বেও প্রায় একক প্রচেষ্টায় ব্যবসাক্ষেত্রে সফল হওয়ার চেষ্টা করছেন আজ অনেকেই। ‘কেরানি’ তকমা ঝেড়ে বাঙালিও চাইছে লক্ষ্মী দেবীকে বাণিজ্যে ফিরিয়ে আনতে। আর সেই সূত্রেই মনে পড়তে পারে স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (Rajendra Nath Mookerjee) নাম। ঔপনিবেশিক বাংলার প্রথম দিককার অন্যতম সফল ‘অন্ত্রপ্রনর’ হিসেবে অনায়াসে ব্যবহার করা যায় তাঁর নাম। অথচ, বাঙালির ‘দুর্বল’ স্মৃতিশক্তি আরো বহু বিষয়ের মতো ভুলিয়ে দিয়েছে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্যের কথা। কলকাতার ডালহৌসি চত্বরের জমজমাট আর. এন. মুখার্জি রোড সাক্ষ্যবহন করছে আজও। তাও পুরো নাম জানে ক-জন?
স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জির গল্প জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে প্রায় দেড়শো বছর আগে। দেশে তখন ইংরেজ আমল। আলিপুর চিড়িয়াখানার সামনে বড়ো মুশকিলে পড়েছেন কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার র্যাডফোর্ড লেসলি। সঙ্গের দেশীয় মিস্ত্রিদের কিছুতেই বোঝাতে পারছেন না কাজের ধরন। ভাষাগত সমস্যা তো আছেই, তাছাড়া তাঁর খাঁটি ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং কার্যপদ্ধতি প্রায় অবোধ্য হয়ে উঠছে। রাজেন্দ্রনাথ তখন সদ্যযুবা, পাশ করেছেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। আগে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকলেও এখন থাকেন মেসে। পরিবারে তীব্র অভাব-অনটন, স্বাধীন ব্যবসা করার ইচ্ছে থাকলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থ। পথে ঘুরতে ঘুরতে আচমককাই একদিন মুখোমুখি হলেন লেসলি সাহেবের সমস্যার। ইংরেজি ভাষার সহজবোধ্য অনুবাদে সকলকে বুঝিয়ে দিলেন প্রযুক্তির জটিল হিসেবনিকেশ। জহর চিনতে ভুল করেননি সাহেব। পরদিন দেখা করতে বললেন তাঁকে। এক অনভিজ্ঞ ভারতীয়ের হাতে তুলে দিলেন জলপ্রকল্প নির্মাণের গুরুদায়িত্ব। অবশেষে স্বপ্নপূরণ হতে চলল রাজেন্দ্রনাথের। বা বলা যায় স্বপ্নের শুরু।
তাঁর জন্ম ১৮৫৪ সালে বসিরহাটের ভ্যাবলায়। ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারান। সেই সময় শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ক্লাস হত প্রেসিডেন্সির ক্যাম্পাসে। শৈশবের বিপর্যয় কাটিয়ে মেধার জোরে সুযোগ পেলেন সেখানে। এবার বাধা হয়ে দাঁড়াল স্বাস্থ্য। তিন বছর পড়াশোনা করার পরেও দিতে পারলেন না পরীক্ষা। সেই সময়েই ঠিক করলেন তথাকথিত কেরানির চাকরির বদলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ব্যবসায়। এমন নয় যে, তখন সফল বাঙালি ব্যবসায়ীর অভাব ছিল। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার ও শিল্পপতি। পলতার জলপ্রকল্পের কাজ দায়িত্বসহকারে পালন করার পর ডাক পড়ে লক্ষ্ণৌ, কানপুর, এলাহাবাদ, আগ্রায়। কলকাতায় পাইপলাইন বসানোর বরাতও পেলেন। সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে ঠিকই, তবু তো করতে হচ্ছে ইংরেজের গোলামি। হঠাৎ-ই ১৮৯২-তে চলে আসে সুবর্ণ সুযোগ। স্যার টমাস অ্যাকুইনাস মার্টিন প্রস্তাব দিলেন যৌথ অংশীদারিত্বে ব্যবসা করার। তৈরি হল ‘মার্টিন অ্যান্ড কোং’ (Martin & Co.)। রেলপথ দিয়ে বড়ো শহরগুলির মধ্যে যোগাযোগ তৈরি হলেও, ছোটো মফস্বল শহর ও গ্রামগুলি তখনও অবহেলিত। রাজেন্দ্রনাথের নজর পড়ল সেই দিকে। বুঝেছিলেন, গ্রামের সঙ্গে শহরকে ঠিকভাবে জুড়তে না পারলে উন্নয়নের বিস্তার সম্ভব নয়। কিংবা হয়তো ভবিষ্যতের বড়ো কলকারখানা তৈরির প্রাথমিক নকশা তৈরি করেছিলেন এভাবেই।
মার্টিন রেলওয়ে কোম্পানির অধীনে শুরু হল ন্যারোগেজ লাইনের কাজ। ছোটো বেসরকারি ট্রেন পরিষেবা পৌঁছে গেল দেশের বিভিন্ন জায়গায় দূর-দূরান্তের মানুষের কাছে। রাজ্যের মধ্যে বারাসাত-বসিরহাট, হাওড়া-আমতা ছাড়াও আরা-সাসারাম, দিল্লি-সাহারানপুর, বিহার-বক্তিয়ারপুরেও বিস্তারিত ছিল ন্যারোগেজ লাইন। ১৯০৬ সালে মার্টিন সাহেবের মৃত্যুর পর কোম্পানির সমস্ত কর্মভার এসে পড়ে তাঁর উপরে। স্বাধীনতার সঙ্গে হাত বাড়ালেন স্থাপত্য নির্মাণের কাজে। ইতিমধ্যে ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খ্যাতি। ওই সময়েই ভারতের ইংরেজ কর্তৃপক্ষ রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিতে নির্মাণ করতে চাইল একটি বিরাট সুদৃশ্য সৌধ। বিখ্যাত স্থপতি এমারসনের নেতৃত্বে ডাকা হল টেন্ডার। রাজেন্দ্রনাথের নকশার সৌজন্যে দেশ-বিদেশের বহু প্রতিযোগীকে হারিয়ে দায়িত্ব পেল ‘মার্টিন অ্যান্ড কোং’। ১৯২২ সালে স্বীকৃতি স্বরূপ পান ‘নাইটহুড’ খেতাব। এরপর একে একে হাওড়া ব্রিজ, বেলুড়মঠ ও মন্দির, টিপু সুলতান মসজিদ, বিধানসভা ভবন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেন। এক অর্থে তাঁকে আধুনিক কলকাতার ‘রূপকার’ বললে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হয় না।
আরও পড়ুন
পাহাড়ের ওপর পাতা হবে রেললাইন, ‘নেটিভ’ শ্রমিকদের ওপর অকথ্য নির্যাতন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের
তবে, কোথাও থামতে চাননি তিনি। রেলপ্রযুক্তি কিংবা স্থাপত্যশিল্পে সীমাবদ্ধ থাকেনি কার্যকলাপ। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ইস্কো কারখানা। জামশেদপুরের টাটাদের কারখানার পর এটিই ছিল দেশের বৃহত্তম ইস্পাত কারখানা। আসানসোল ও কুলটির বেশ কয়েকটি বিখ্যাত স্থানও নির্মাণ করেন। ১৯৩৬-এ তাঁর মৃত্যুর পর সুযোগ্য পুত্র ‘স্যার’ বীরেন্দ্রনাথ মুখার্জির (Sir Biren Mookerjee) হাতে আরও দ্রুত হয় ইস্কোর অগ্রগতি। এছাড়া খেলাধূলা-সহ আরও অনেক বিষয়ে আগ্রহ ছিল রাজেন্দ্রনাথের। তবে শেষ পর্যন্ত প্রাধান্য পেয়েছিল ব্যবসাই। যে কারণে ত্যাগ করেছিলেন ইংরেজ আমলের মন্ত্রিত্বের পদ। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কেরানি হওয়ার দিন শেষ। বাঙালি ব্যবসা জানে না, এই বদনামের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন মূর্তিমান প্রতিবাদ। শূন্য থেকে উঠে এসে তৈরি করেছিলেন বিরাট এক ‘সাম্রাজ্য’। অথচ, আজ তিনি প্রায় হারিয়ে গেছেন স্মৃতির অতলে। ‘স্টার্ট আপ’-এর যুগে দাঁড়িয়ে বাঙালি কি একবার মনে করবে না তাঁকে?
আরও পড়ুন
আবিষ্কার করেছেন একের পর এক যন্ত্র, নিয়েছেন পেটেন্ট; বিস্মৃতির আড়ালে বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার
Powered by Froala Editor