‘দেবদাসী প্রথা’-র বাঁধন ভেঙে শাস্ত্রীয় সংগীতকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেন শুভলক্ষ্মী

জহরলাল নেহরু তাঁকে বলতেন ‘সঙ্গীতের রানি’। আত্মমগ্ন হয়ে যখন ‘হরি তুম হরো জান কি পীর’ ভজনটি ধরতেন, তখন গান্ধীজি যেন শুনতে পেতেন স্বয়ং মীরার কণ্ঠস্বর। লতা মঙ্গেশকরের কাছে তিনি ‘তপস্বিনী’। কিশোর আমোনকার বলতেন, তাঁর গলায় বসে ‘অষ্টম সুর’। তাঁর কণ্ঠের আত্মনিবেদন যেন সংগীতের রাগ-রাগিনীর ঊর্ধ্বে উঠে চিরশুদ্ধতার প্রবাহ ঘটাত শ্রোতার হৃদয়ে। নিরবচ্ছিন্ন সাধনা ও প্রথাবিরুদ্ধতার আগুনে শুদ্ধ হয়েছিল তাঁর জীবন। ভারতসহ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ভক্তিসংগীতের প্রার্থনার আকুতি। তিনি কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সংগীতের বিদূষী এম এস শুভলক্ষ্মী (M.S. Subbulakshmi)।

জন্ম ১৯১৬ সালে মাদুরাইয়ে। পুরো নাম মাদুরাই সম্মুখাবদিভু সুব্বুলক্ষ্মী। যদিও বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাওয়ায়, ভালোবাসার নাম ‘শুভলক্ষী’ বলেই তিনি পরিচিত। ছিলেন দিলীপ রায়ের ‘শিষ্যা’। গেয়েছেন অসংখ্য রবীন্দ্রসংগীত ও দ্বিজেন্দ্রসংগীত। কর্ণাটকী উচ্চারণের আশ্চর্য মাদকতায় বাংলা গানে ছড়িয়ে পড়ত শ্রদ্ধার শ্রাবণধারা। প্রথম শিক্ষাগুরু অবশ্য মা সন্মুকাভাদিভের আম্মাল। পিতার নাম সুব্রমানিয়া আইয়ার। সেম্মানগুডি শ্রীনিবাস আইয়ারের কাছে গান শেখার পর হিন্দুস্তানি সংগীতের তালিম নেন নারায়ণ রাও ব্যাসের অধীনে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথমবার মঞ্চে ওঠেন। তখনও বীণাবাদক রূপে সঙ্গ পেয়েছিলেন মায়ের। 

মা ছিলেন মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী মন্দিরের ‘দেবদাসী’। ঈশ্বরই তাঁদের ‘স্বামী’, মন্দির বাসস্থান। জীবনের কঠিনতম লড়াই শুরু সেখান থেকে। শুভলক্ষ্মীর প্রতিভা শুধুমাত্র মন্দিরের দেবতার জন্য নিবেদিত হোক, চাননি আম্মাল। দেবদাসী প্রথার প্রতিবন্ধতাকে অস্বীকার করে মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন চেন্নাই। একদিকে ধর্মীয় বিধিনিষেধ, অন্যদিকে সামাজিক ভ্রূকুটি। সব কিছু প্রতিহত করে মাত্র ১০ বছর বয়সে রেকর্ড করেন প্রথম গান। ১৩ বছরে ভজন পরিবেশন করেন মাদ্রাজ মিউজিক আকাদেমিতে। আদরের ‘কুঞ্জআম্মা’-র জীবনের একটা অধ্যায় সমাপ্ত করে যাত্রা শুরু হল বৃহত্তর জগতের উদ্দেশ্যে। কপালে বড়ো সিঁদুরের ফোঁটা, হাতে ফুলের মালা আর নাকচাবিতে সুসজ্জিত রূপলাবণ্যের সঙ্গে ঐশ্বরিক সংগীতসাধনায় কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সংগীতকে ছড়িয়ে দেন জনমানসে। 

১৯৪০-এ বিয়ে হয় প্রখ্যাত সাংবাদিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী টি সদাশিবমের (T. Sadasivam) সঙ্গে। দেশের বহু নেতৃস্থানীয়দের কাছে পৌঁছে যায় শুভলক্ষ্মীর জাতীয়তাবাদী গান। আলাপ হয় গান্ধীজি ও নেহরুর সঙ্গে। দেশের মেয়েদের উন্নতিকল্পে অংশগ্রহণ করেন একাধিক অনুষ্ঠানে। প্রথম মহিলা সংগীতশিল্পী হিসেবে পুরুষদের সঙ্গে সংগীত পরিবেশন করেন মৃদঙ্গ ও ভায়োলিন সহযোগে। যা নিয়ে বিতর্কও হয়। 

আরও পড়ুন
অজস্র ‘আধুনিক’ গানের পরও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ সন্ধ্যা

তিনের দশকের শেষ দিকে টি সদাশিবম একটি জাতীয়তাবাদী পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। অথচ, পর্যাপ্ত অর্থের অভাব। সেই কারণেই সংগীতসাধনার পাশাপাশি শুভলক্ষ্মী নিজেকে মেলে ধরলেন আরেকটি মাধ্যমে। ১৯৩৮-এ মুক্তি পায় প্রথম অভিনীত ছবি ‘সেবাসদানম’। বছর কয়েক পরে ‘সাবিত্রী’ চলচ্চিত্রে নারদের ভূমিকায় অভিনয় করেন পুরুষচরিত্রে। ১৯৪৫-এ যেন পূর্ণতা পায় তাঁর অভিনেত্রী জীবন। ‘মীরাবাঈ’-এর নামচরিত্রে অভিনয়ে নিজের শিল্পী জীবনের সমস্ত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি উজাড় করে দেন। ১৯৫০-এ হিন্দিতেও মুক্তি পায় ছবিটি। 

আরও পড়ুন
এসডি বর্মণ এবং আরডি বর্মণের বাড়িতেই সঙ্গীত মিউজিয়াম, উদ্যোগ কলকাতা পুরসভার

কন্নড় ভাষা ছাড়াও ভজন পরিবেশন করেছেন হিন্দিতে। মূলত, তার সুবাদেই অর্জন করেন সারা ভারতব্যাপী জনপ্রিয়তা। মালয়ালম, মারাঠি, পাঞ্জাবি, গুজরাতি ভাষাতেও ছড়িয়ে আছে শুভলক্ষ্মীর শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগ। তাঁর কণ্ঠে ‘হে নূতন’, ‘আমার মল্লিকাবনে’ কিংবা ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা’ গানগুলি শুধু বাংলার নয়, সমগ্র বিশ্বের সম্পদ। দেশীয় সংগীতকে সত্যিই তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে। ইংল্যান্ডের রয়াল অ্যালবার্ট হল মুখরিত হয়েছিল তাঁর আলাপের মাধুর্যে। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইউনাইটেড নেশনের সভায় সংগীত পরিবেশনের কৃতিত্ব তাঁর। অবশ্য ১৯৯৭-এ স্বামীর মৃত্যুর পর প্রকাশ্য সংগীতানুষ্ঠান বন্ধ করে দেন। 

পেয়েছেন পদ্মভূষণ, সংগীত-নাটক আকাদেমি পুরস্কার। ‘এশিয়ার নোবেল’ বলে পরিচিত র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান ১৯৭৪ সালে। এক্ষেত্রেও তিনি প্রথম ভারতীয় সংগীতশিল্পী। ১৯৯৮-এ পান ভারতরত্ন সম্মান। জন্মশতর্ষে ২০১৬ সালে বিশেষ ডাকটিকিট প্রকাশ করে রাষ্ট্রসংঘ। ২০০৬ সালে পরলোকগমন করেন এম এস শুভলক্ষ্মী। সংগীতের সঙ্গেই ‘স্টাইল আইকন’- রূপেও খ্যাতি ছিল তাঁর। সংগীতে ও জীবনে নিজেকে ভেঙেছেন বারবার। দেবদাসী প্রথার অন্ধ কুঠুরি থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ছোটোবেলায়। সেই কারণেই হয়তো জানতেন বন্ধনের প্রকৃত অর্থ। কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সংগীতকে মুক্তি দিয়েছিলেন বিশ্বের মাঝে। আর অবিরত ভক্তিতে নিজেকে মগ্ন করে রেখেছিলেন সাধিকার ধ্যানস্থ মন্ত্রশুদ্ধিতে।

চিত্রঋণ : msstribute.org

Powered by Froala Editor

Latest News See More