১৯২৮ সাল। সদ্য কিশোরী এক মেয়ের হাতে পিতা সুরেশচন্দ্র মজুমদার তুলে দিলেন আগ্নেয়াস্ত্র। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে কলকাতা থেকে ঢাকায় অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য এরচেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা আর কী হতে পারে? আট বছর বয়সে মাতৃহীন কন্যাকে এভাবেই গড়ে তুলেছিলেন পিতা। খুব ছোটো বয়স থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় সশস্ত্র সংগ্রাম। মুখে বিপ্লবের বুলি আউড়ে নয়, গোপনে অস্ত্র চালানের হাতে-কলমে শিক্ষার মাধ্যমেই স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবেশ ঘটে উজ্জ্বলা মজুমদারের (Ujjwala Majumdar)।
১৯১৪ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকায় জন্ম তাঁর। কুসুমহাটির মজুমদার পরিবারকে তখন জমিদারির পাশাপাশি সাহস ও বীরত্বের জন্য এক ডাকে চেনে মানুষ। সেই ঐতিহ্যকেই এগিয়ে নিয়ে চললেন উজ্জ্বলা। আর সময়টাও তো লড়াইয়ের। একদিকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, অন্যদিকে রাইটার্সের ‘অলিন্দ যুদ্ধ’। বাংলায় বিভিন্ন প্রান্তে অত্যাচারী ইংরেজ শাসকদের উপর গর্জিত হচ্ছে বন্দুকের নল। শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী হত্যা করেছেন ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেনসনকে। বীণা দাস সেনেট হলে গুলি চালিয়েছেন জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে। শহিদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার যেন ঘরে ঘরে ডাক পাঠাচ্ছেন তরুণ-তরুণীদের এগিয়ে আসার জন্য। এই অবস্থায় কি চুপ করে বসে থাকা সম্ভব উজ্জ্বলার পক্ষে? ছোটো থেকেই নাড়াচড়া করছেন বন্দুক নিয়ে। তাঁদের বাড়ি ছিল বিপ্লবীদের আড্ডার জায়গা। দুঃসাহসী উজ্জ্বলা তিনের দশকের উত্তাল রাজনীতির দিনগুলিতে অবতীর্ণ হলেন নিজস্ব অবতারে।
শৈশবের অনেকটা সময় গ্রামে থাকার কারণে পড়াশোনা শুরু করতে একটু দেরি হয়েছিল তাঁর। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় বয়স ছিল প্রায় কুড়ি বছর। পরীক্ষার কিছুদিন পর বাড়িতে জানালেন এক বন্ধুর বাড়িতে ঘুরে আসার কথা। আসলে অত্যন্ত গোপনে উজ্জ্বলা ও মনোরঞ্জন ব্যানার্জি গিয়ে উঠলেন দার্জিলিংয়ের স্নো-ভিউ হোটেলে। সঙ্গে একটি হারমোনিয়াম। যার মধ্যে লুকিয়ে আনা দুটি পিস্তল তুলে দিতে হবে জুবিলি স্যানাটোরিয়ামে ইতিমধ্যেই উপস্থিত ভবানী ভট্টাচার্য ও রবি ব্যানার্জির হাতে। এবারের লক্ষ্য অত্যাচারী গর্ভনর অ্যান্ডারসন। কিন্তু কিছুতেই হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না সাহেবকে। দার্জিলিংয়ের একটি ‘ফ্লাওয়ার শো’-তে আসার কথা থাকলেও, কার্যোদ্ধার হল না। হাল ছাড়লেন না বিপ্লবীরা। অপেক্ষা করতে লাগলেন সঠিক সময়, সঠিক মুহূর্তের।
১৯৩৪ সালের ৮ মে। লেবং-এর ঘোড়দৌড়ের মাঠে উপস্থিত হবেন অ্যান্ডারসন। যেভাবে হোক, এখানেই শেষ করতে হবে তাঁকে। তাতে যদি ধরা পড়তে হয়, মৃত্যুবরণও করতে হয়, হাসি মুখে মেনে নেবেন নিজেদের ভবিষ্যতকে। হোটেল থেকে অত্যন্ত দামি ইউরোপীয় পোশাকে বেরোলেন ভবানী ও রবি। সঙ্গে লুকোনো রিভলভার। একটু দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছেন উজ্জ্বলা ও মনোরঞ্জন। উজ্জ্বলার পরনে রঙিন শাড়ি, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। এই বেশে তাঁকে আগে কেউ কখনও দেখেনি। অন্যদিকে খাঁটি স্বদেশি পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়েছেন মনোরঞ্জন ব্যানার্জি।
আরও পড়ুন
নিজে হাতে বন্দুক চালাতে শেখান মহিলাদের, বাংলার বিপ্লববাদের সঙ্গে জড়িয়ে নিবেদিতার ভূমিকা
সময়মতো পৌঁছোনো গেল ঘোড়দৌড়ের মাঠে। ওই তো বসে আছেন অ্যান্ডারসন। ভিড়ের মধ্যে গর্জে উঠল ভবানীর রিভলভার। কিন্তু এতটা দূর থেকে লক্ষ্য ফসকে গেল তাঁর। রবির গুলি গিয়ে লাগল দুই ইংরেজ সাহেবের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল ব্রিটিশ পুলিশ। গুরুতর আহত অবস্থায় দুজনকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। লেবংয়ে যখন গুলিচালনার ঘটনা ঘটছে, তখন উজ্জলারা কোথায়? তাঁরা তখন দার্জিলিং থেকে উঠে বসেছেন কলকাতাগামী ট্রেনে। সেরকমই নির্দেশ ছিল দলের। কিন্তু খবর চাপা থাকে না। সন্ধ্যার সময় ট্রেন শিলিগুড়ি পৌঁছোতেই খানাতল্লাশি শুরু করল পুলিশ। তাদের কাছে খবর আছে, রঙিন শাড়ি ও হাই পাওয়ারের চশমা পড়া এক যুবতী পালাচ্ছেন এই ট্রেনে। অ্যান্ডারসন হত্যাচেষ্টার অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্ব ছিল তাঁর। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। ১৪ বছর বয়স থেকে যিনি আঁচলে বন্দুক বেঁধে কলকাতা-ঢাকা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁকে ধরা কি এতই সহজ? পুলিশের চোখের সামনেই চুপচাপ বসে রইলেন চশমাহীন, সাদা শাড়ি এক মহিলা। তাঁর নাম উজ্জ্বলা মজুমদার।
আরও পড়ুন
তাঁর নামেই নামকরণ 'আলিমুদ্দিন স্ট্রিট'-এর, বিস্মৃতির অতলে বাঙালি বিপ্লবী
পরে অবশ্য ধরা পড়েছিলেন উজ্জ্বলা ও মনোরঞ্জন। সেটা কলকাতায় এসে। ভবানীপুরে শোভারাণী দত্তের বাড়িতে থাকাকালীন আর পালাতে পারলেন না পুলিশের নজর থেকে। বিচারে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয় উজ্জ্বলার। ২০ বছরের সাজা হয় রবি ও মনোরঞ্জনের। আর ১৯৩৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসি হয় ভবানী ভট্টাচার্যের। সেই রাতে উজ্জ্বলার বারবার মনে পড়ত লাগল অসীম সাহসী বন্ধুর কথা। তিনি লিখছেন, “দূরান্তের অপর এক জেলে বসে শুনি, রাত্রির গভীরে কিশোর বন্ধুর কণ্ঠে তুলে দিয়েছে ফাঁসীর রজ্জু বিদেশী শাসক। মুহূর্তে ধূলায় গড়িয়েছে তার সোনার শরীর। সে দুঃসহ রজনীর ব্যথাবিধুর ইতিহাস জীবনে ভুলবার নয়।”
পরবর্তী পাঁচবছর বাংলার বিভিন্ন জেলে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে উজ্জ্বলাকে। কিন্তু একদিনের জন্য ভোলেননি নিজের লক্ষ্য। ক্লান্ত হয়ে সঙ্গ ছাড়েননি বৈপ্লবিক উন্মাদনার। তাই গান্ধীজির আবেদনে মুক্তি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ফের ঝাঁপিয়ে পড়েন আগস্ট আন্দোলনে। পরে যুক্ত হন ফরওয়ার্ড ব্লক ও শরৎচন্দ্র বসুর সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে। ১৯৪৮ সালে বিবাহ করেন ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়কে। আজ কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের নাম ‘ভবানী ভবন’। হ্যাঁ, শহিদ ভবানী ভট্টাচার্যের নামেই পরিচিত ঐতিহ্যবাহী এই বাড়িটি। অনেকের কাছেই হয়তো অপরিচিত তাঁর ইতিহাস। কিন্তু উজ্জ্বলা মজুমদার? কোনো বিখ্যাত স্থাপত্যে না হোক, তাঁর ভূমিকাকে কি স্মৃতিতে ধরে রাখতে পেরেছে বাঙালি?
Powered by Froala Editor